একেবারে সহজিয়া কথা হচ্ছে, নিঝুমদ্বীপে দেখার মত তেমন কিছু নেই কিন্তু আপনার যদি দুইটা বৈশিষ্ট থাকে তবে আপনি নিঝুমদ্বীপ ট্রিপটিকে স্মরণীয় করে রাখতে পারবেন; এক, আপনার মধ্যে অল্পতেই সন্তষ্ট হবার একটা বৈশিষ্ট থাকতে হবে এবং দুই, আপনাকে নির্দিষ্ট ছকের বাইরে গিয়ে কিছু আউলা-ঝাউলা কাজ করতে হবে। সে গল্পই বলব আজকে।
প্রথমেই বলব, আপনি কেন নিঝুমদ্বীপ যাবেন? আপনি নিঝুমদ্বীপ যাবেন শহরের স্ট্রেস রিলিভ করতে, প্রকৃতির কোলে একটু দোল খেতে কিংবা সেথায় বিচরণ করতে করতে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়তে, সবুজ ঘাসের উপর টার্প বিছিয়ে তাতে শুয়ে আকাশে তারাদের মেলা দেখতে; সেখানে শহুরে জীবনের টেনশন নেই, যন্ত্রণা নেই, অফিস পলিটিক্স নেই, পারিবারিক জ্বালা নেই!
এই ফিল কি অন্যান্য জায়গাতেও পাওয়া যায়? হ্যাঁ, পাওয়া যায়; আপনি যদি সোনাদিয়াতে ক্যাম্পিং করতে যান কিংবা কুতুবদিয়া বা চর কুকরি মুকরিতে ক্যাম্পিং করতে যান, সেসব জায়গাতেও আপনি এমনই ফিল পাবেন!
বংগোপসাগর ও আমাদের নদীগুলোর মোহনার বৈশিষ্ট মোটামুটি একইরকম, সবখানেই জোছনা সবার সাথে গোপনে আলাপ করে, জোছনা যখন না থাকে তখন আকাশের তারারা এসে উঁকিঝুঁকি মেরে প্রক্সি দেয়, সব জায়গাতেই সেখানকার অধিবাসীদের পুরোপুরি গ্রামীণ সাজে পাবেন, তাদের মধ্যে নেই কোন আড়ম্বর, মাঝে মাঝে শহুরে পোশাক পরা লোকেরা যখন তাঁবু নিয়ে হাঁটে তখন তারা অবাক নেত্রে তাকায় তবে অবাক হবার সেই হার ইদানিং কমে এসেছে; অবাক হবার বদলে তারা এখন কি করে অতিথিদের কাছে পণ্য বিক্রি করা যায় সেই চেষ্টা করছে!
আর এক মিনিট দেরি হলে হাতিয়ার তমুরদ্দি ঘাটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া ফারহান-৩ লঞ্চটা মিস করতাম, কিন্তু করিনি; জগন্নাথ কলেজ পেরিয়ে রিক্সা ছেড়ে দিয়ে ভিড় ঠেলে দিলাম দৌড়, এক দৌড়ে লঞ্চে। তবে ততোক্ষণে তারা লঞ্চে ওঠার তক্তা সরিয়ে ফেলেছিল, একজন আমাকে টেনে তোলায় রক্ষা!
কেবিন নাম্বার ৩০৩, আগে যতবার বড় লঞ্চে বরিশাল গিয়েছি, কোনবারই ঘুমাতে পারিনি; মূলতঃ ২০০৪ সালের ৯ই এপ্রিল সোহাগের এসি গাড়িতে চট্রগ্রাম যাবার পথে একটা বড় ডাকাতি হয়েছিল আমাদের বাসে, একজন রাখাইন যুবক মারা গিয়েছিল সেই ঘটনায়, তখন থেকেই আমি যে কোন জার্নিতে রাতে ঘুমাতে পারি না।
কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে এই লঞ্চের কেবিনে আমি পর্যাপ্ত ঘুমালাম, আগে কখনো লোকাল লঞ্চে চড়িনি, এবার তাতেও চড়লাম। হাতিয়া যেতে যে কত স্টেশন আছে, তার আর হিসেব নেই, ঘুমের মধ্যেও টের পেয়েছি যখন একেকটা ঘাটে লঞ্চ থামত।
নিঝুমদ্বীপের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছি ভ্রমণপ্রিয় গ্রুপের এডমিন মাসুম বাচ্চার মত দেখতে আল-মাসুমের সাথে; সদস্য সব মিলিয়ে ৭ জন। শুরুতেই খাতির হয়ে গেছে কিশোরগঞ্জের রিয়েল ভাই আর নোয়াখালীর ফারুখ ভাইয়ের সাথে। মাসুমসহ চারজন একসাথে চা পান করতে নীচে গেলাম; সেখানে ঝালমুড়ি, ডিম আর চা পান করে বাদাম কিনে বাদাম ছিলে খেতে খেতে আড্ডায় বসলাম।
পরিচয়ের প্রথম পাঠ সমাপ্ত করে এশার নামাজ আদায় করে আমি একটু আগেই ঘুমাতে গেলাম; একটু রাত থাকতেই উঠলাম, তাতে ওজু করতে সুবিধা হলো। ফজরের টাইম হবার আগেই লঞ্চ হাতিয়ার তমুরদ্দি ঘাটে ভিড়ে গেল। এখান থেকে যাত্রা হবে প্রথমে সিএনজিতে ৩৫ কিমি রাস্তা পেরিয়ে মোক্তারিয়া ঘাট, সেখান থেকে ট্রলারে ১০ মিনিটের নদীপথ পেরিয়ে অপর পাড়ে বন্দরটিলা ঘাট এবং সেখান থেকে সিএনজিতে এক ঘন্টায় নামার বাজার; মূলতঃ এটিই নিঝুমদ্বীপের বড় বাজার।
এখানে মোট ৭ টি হোটেল আছে, এই বৃহস্পতিবার সবগুলি হোটেলই বুকড ছিল, এর বাইরে তাঁবু ছিল মোট ২০ টি; একেবারে খারাপ না। এর মধ্যে সোনাদিয়ায় রাত্রিযাপন বন্ধ করে দেয়ায় পর্যটকের চাপ কিছুটা বেড়েছে বলে ধারণা করি। তবে ৩৫ কিমি রাস্তার অবস্থা খারাপ হওয়াতে এই জার্নিকে কঠিনই বলা যায়। মনপুরা নেমে সেখান থেকে যদি রিজার্ভ ট্রলারে আসা যায়, এটা বেটার, তবে বড় বোট নিতে হবে, ছোট বোট নিলে মেঘনার ঢেউয়ে নতুন পর্যটকের বেহাল দশা হয়ে যাবে!