মেঘের কোলে ক্যাম্পিং । মারায়ন তং । Marayantong

মারায়ন তং ক্যাম্পিং: বুদ্ধের মূর্তি পেরিয়ে বটগাছের ওপারের দৃশ্য দেখে দু’নয়ন জুড়িয়ে গেল; এমন সুন্দর দৃশ্য সহসা চোখে পড়ে না। সূর্যের শেষ কিরণ ওপাশের পাহাড়ের গাছ-গাছালির গায়ে আছড়ে পড়ে এক অদ্ভুত দ্যোতনা’র সৃষ্টি করেছে, অনেক নীচ পর্যন্ত একেবারে ক্লিয়ার দেখা যাচ্ছে।

মারায়নতং ক্যাম্পিং

মারায়ন তং ক্যাম্পিং

মারায়ন তং পাহাড়ে ক্যাম্পিং এর সাধ অনেকদিনের কিন্তু সুযোগ করে উঠতে পারছিলাম না; অবশেষে রওনা দিলাম ‘ঘুরবো দুনিয়া’ গ্রুপের আরিফ ভাইয়ের সাথে।

এক নজরে মারায়ন তং:

  • বান্দরবান জেলার আলীকদম থানায় অবস্থিত
  • সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে পাহাড়টির উচ্চতা প্রায় ১৬৪০-১৬৬০ফুট!
  • মাতাই হিল, মেরাই তং জাদি, মারায়ং তং, মেরাইথং সহ বিভিন্ন নামে পরিচিত।

চট্টগ্রাম থেকে মারায়ন তং

চকরিয়া নেমে আলীকদমের বাসে করে আলীকদম আবাসিক-এ অবস্থিত ইয়াসিনের দোকান পর্যন্ত যেতে সকাল ৮ঃ০০ টা বেজে গেল; সেখানে নাস্তা করতে করতেই আলাপ হলো কিভাবে আমরা আলীর গুহায় যাব।

রহস্যময় আলীর গুহা

গাড়ি এলে ইয়াসিনের দোকানে ব্যাগ রেখে রওনা হলাম সবাই মিলে আলীর গুহা দেখতে; এত নাম শুনেছি এটি’র, সবাই বলে রহস্যময় গুহা, এটি না দেখে ফিরে যাওয়া যায় না।

গিয়ে দেখলাম, এই গুহা তৈরি হয়েছে দুইভাবে বিভক্ত হয়ে যাওয়া আলীর পাহাড়ে। এই দুই পাহাড়ের মাঝখানের সরু পথ ধরে অনেকখানি গেলে পাওয়া যায় দুটি লোহার সিঁড়ি, সেঁই সিড়ি বেয়ে উপরে উঠলেই পাওয়া যায় এই গুহা মুখ।

ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার, একটা ভুতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করে। আমি গুহার শেষ মাথা পর্যন্ত গিয়েছি, জায়গাটা আমার খুবই ভালো লেগেছে। 

মারায়ন তং পাহাড়ে যাবার প্রস্ততি

ফিরে এসে লাঞ্চ করলাম ইয়াসিনের হোটেলে; এরপর মারায়ন তং পাহাড়ে যাবার প্রস্ততি। বিকেল হয়ে এলে পাহাড়ে উঠতে শুরু করলাম দল বেঁধে; আমার দুই প্রিয় সংগী হয়ে গেল দীপু ভাই আর শিপু ভাই। গল্প করতে করতে দেড় ঘন্টা পরে উঠে পড়লাম পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয় এই পাহাড়ে।

এখানে প্রচুর পর্যটক আসে এবং তাদের ব্যাগ টানা পোর্টার হিসেবে এলাকার ছোট বাচ্চারা আগ্রহ ভরে কাজ করে; ব্যগ প্রতি তাদের চার্জ ১০০ টাকা আর ২ লিটার পানির বোতল ক্যারিং চার্জ ২০ টাকা।

আমার ব্যাগটা একটা বাচ্চাকে দিয়ে তার সাথে গল্প করতে করতে এগোলাম; জীবন তাকে এখনি পোর্টার বানিয়ে দিয়েছে। ইন্টারেস্টিংলি, এসব বাচ্চাদের অনেকেই এখন বার-বি-কিউ বানাতে শিখে গেছে।

মারায়ন তং পাহাড়ে যখন উঠেছি, তখন সূর্য একেবারেই পশ্চিমে হেলে পড়েছে; আমাদের তাঁবুগুলো ইয়াসিনের লোকেরা পিচ করে দিয়েছে। আমরা সেই তাঁবুতে বসে প্রথমেই কিছু ছবি তুলে নিলাম।

মারায়নতং ক্যাম্প সাইট
মারায়ন তং ক্যাম্প সাইট

ক্যাম্পিং সাইট থেকে মারায়ন তং পাহাড় চূড়া

এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম মারায়ন তং পাহাড়ের চূড়ায় যাব; আসলে মারায়ন তং পাহাড় চূড়া আর ক্যাম্পিং সাইট কিন্তু এক নয়। ক্যাম্পিং সাইট থেকে ১০/১৫ মিনিট ট্রেকিং করে চূড়ায় উঠতে হয়।

মারায়ন তং পাহার চূড়া
মারায়ন তং / মারায়ং তং ক্যাম্প সাইট থেকে দেখা পাহার চূড়া

সেখানে বড়সড় একটি বৌদ্ধ মূর্তি আছে। সেই মূর্তি পেরিয়ে বটগাছের ওপারে গিয়ে দু’নয়ন জুড়িয়ে গেল; এমন সুন্দর দৃশ্য সহসা চোখে পড়ে না। সূর্যের শেষ কিরণ ওপাশের পাহাড়ের গাছ-গাছালির গায়ে পড়ে এক অদ্ভুত দ্যোতনা’র সৃষ্টি করেছে, অনেক নীচ পর্যন্ত একেবারে ক্লিয়ার দেখা যাচ্ছে।

পাহাড় থেকে সূর্যাস্ত

সূর্য অস্ত যাবার প্রাক্কালে আমরা এসে বটগাছের নীচে বসলাম। এখানে থেকে সূর্যাস্ত এত সুন্দর লাগছে, তা বলবার ভাষা আমার নেই; গত দেড় বছরেরও বেশী সময় ধরে সেই সূর্যাস্তের ছবি আমার ল্যাপটপের ওয়ালপেপার হিসেবে রেখে দিয়েছি।

মারায়ং তং পাহার চূড়া
পাহাড় চূড়া থেকে দেখা সূর্যাস্ত

সূর্য অস্ত গেলে ধীরে ধীরে নেমে এলাম; পানির ক্রাইসিস আছে, এর মধ্যেই কোনক্রমে ওযু করে তাঁবুতে ঢুকে মাগরিবের নামাজ পড়লাম। আজ রাতটা কাটবে মারায়ন তং পাহাড়ের এই তাঁবুতে!

আকাশের অজস্র তারা আজ সাথী হয়ে রইবে। আজ একসাথে অনেকগুলো অভিজ্ঞতা লাভ করলাম; একটি হলো, যেখানে ঘরের মধ্যে বাংলালিংকের নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না, সেখানে এই পাহাড়ের চূড়ায় রীতিমতো ইন্টারনেট পাওয়া যাচ্ছে!

আজ অনেকগুলো টিম এই পাহাড়ে রাত্রিযাপন করার জন্য তাঁবু টানিয়েছে। সন্ধ্যার পর তারা ক্যাম্প ফায়ার করেছে এবং এটাকে ঘিরে গীটার বাজিয়ে গান গাচ্ছে। আমি বিষয়টাকে এড়িয়ে আকাশের তারার প্রতি মনপ্রাণ নিবদ্ধ করার চেষ্টা করছি।

একসময় বার-বি-কিউ খাবারের জন্য ডাক পড়লে গিয়ে খাবার খেলাম এবং ফিরে এসে আকাশের তারা দেখতে বসলাম।

ভোরে পাহাড় চূড়ায় মেঘ আর সূর্যের লুকোচুরি

ভোর বেলা উঠে ফজরের নামাজ পড়ে আবার পাহাড় চূড়ায় মেঘ দেখতে গিয়ে দেখি আমার আগেই অনেকে চলে এসেছে। সূর্য উঠি উঠি করে কুয়াশার কারনে পেরে উঠছে না কিন্তু মেঘের ভেলা ধীরে ধীরে দৃষ্টিগোচর হতে শুরু করেছে; হায় এ যেন আরেক সাজেক!

মেঘের কোলে ক্যাম্পিং । মারায়ন তং । Marayantong
সাদা মেঘের ভেলা!

সবাই চেষ্টা করছে আজকের এই সকালটুকু ক্যামেরায় ধরে রাখতে; আমি বিস্ময়ে ভাবছিলাম, এই একই জায়গায় গতকাল বিকেলে দেখেছিলাম একেবারে পরিষ্কার পাহাড় আর আজ ভোরে সেই ফাঁকা জায়গাকে চাদরের মত ঢেকে দিয়েছে মেঘমালা।

সূর্য তেতে উঠছে; মেঘমালা উবে যেতে শুরু করবে শীঘ্রই। আমরা তল্পিতল্পা গুছিয়ে নামা প্রস্ততি নিলাম; নামতে নামতেও বারবার মেঘের ভেলার দিকে তাকাচ্ছিলাম; আমার জীবনের প্রথম ক্যাম্পিং হলো এই মারায়ন তং এর মেঘের পাশে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top