হোটেল গ্রেস-ইনে ঈদের দিন ভোরে উঠে ফজরের নামাজ পড়লাম বটে কিন্তু মন শান্ত হচ্ছিল না ঈদের নামাজ পড়তে পারব কিনা এই অনিশ্চয়তায়! ২৮ ঘন্টা জার্নি করে আগের রাতে সাড়ে এগারোটায় ঢুকেছি ফ্যামিলিসহ; ভোর রাত চারটায় ড্রাইভার দীপেশ ফোন করে জানতে চাইল, টাইগার হিল যাব কিনা? বলে দিলাম, যাব না; সবাই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, এই সময় টাইগার হিল যাবার কোন মানে নেই। ঠিক হলো, সকাল আটটায় বের হবো।
নাস্তাপর্ব শেষ করে, সোয়া আটটায় দীপেশকে পাওয়া গেল। এদিকে আমার মনে খচখচানি চলছে; সারাটা রোজার মাস তারাবীহ পড়ে, রোজা রেখে এমন একটা জায়গায় বেড়াতে এলাম, যেখানে ঈদের নামাজ পড়তে পারব কিনা অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
ঠিক সেই সময়, সামনে দিয়ে দুটি কিশোর যাচ্ছিল নতুন পাজামা-পাঞ্জাবি পরে যাদের দেখেই মনে হয়েছে এরা মুসলিম হবে এবং এটি তাদের ঈদের ড্রেস। একজনকে থামালাম, ইংরেজিতেই জানতে চাইলাম, সে মুসলিম কিনা; বলল, সে মুসলিম। জিগ্যেস করলাম, তোমাদের ঈদের নামাজ কোথায় হয়? বলল, কাছেই এই পাহাড়ের নীচে দার্জিলিং জামে মসজিদ, এখানে নামাজ হবে সাড়ে নয়টায়; আমার মনটা ভীষণ ভালো হয়ে গেল।
দীপেশকে নামাজের সময় জানালাম; সে বলল, গাড়িতে ওঠো। হাতে এক ঘন্টা দশ মিনিট সময় আছে; সে একটানে নিয়ে গেল জাপানিজ টেম্পল ও পিস প্যাগোডাতে। আমি সাধারণত অন্য ধর্মের উপাসনালয়ে যাই না; মূলতঃ এসব স্পট প্যাকেজের মধ্যে থাকে বলেই ড্রাইভারদের একটা দায়িত্ব হয়ে যায় স্পটগুলো দেখানোর।
জাপানিজ টেম্পল ও পিস প্যাগোডার বহিরাবরন দেখতে সুন্দর, এলাকাটা পরিপাটি করে সাজানো। পুরো দার্জিলিংয়েই শীতের ফুল প্রায় ঝরে গেছে, তবু নানান গাছ-গাছালি ও বাগানে এটি দর্শনীয় হয়ে উঠেছে। পিস প্যাগোডার উপরে উঠে যখন একটি শর্টি ভিডিও বানানোর প্রস্ততি নিচ্ছি, তখনই আমার বড় ছেলে শায়ান বলে উঠলো, বাবা, পিছনে এটা কি?
পিছনে তাকিয়ে দেখি, বিশালাকার কাঞ্চনজঙ্ঘা যেন আমার মাথার উপর এসে দাঁড়িয়েছে। বিস্ময়ে মুখ আমার হা হয়ে গেছে! দুই মাস আগে সান্দাকফু ঘুরে এলাম এই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার জন্য, দেখেছিও তবে এটি আরো অনেক কাছে মনে হলো। বিস্ময় কেটে যেতেই আমার দূর্বল ক্যামেরা্য কাঞ্চনকে ধরার চেষ্টা করলাম।
সেখান থেকে একেবারে জামে মসজিদে। মসজিদ লোকে লোকারণ্য; প্রায় দেড় থেকে দুই হাজার মুসল্লী দার্জিলিং জামে মসজিদে নামাজ পড়তে দাঁড়িয়েছে। এত লোক আমি আশা করিনি; সম্ভবতঃ আশেপাশের সব এলাকা থেকে কেবল আজকে নামাজ পড়তেই এসেছে। ইমাম সাহেব বয়ান করছেন হিন্দিতে; বোঝা যায় বয়স্ক মানুষ কিন্তু কন্ঠের মধ্যে মারাত্মক দৃঢ়তা আছে। এখানেও দেখলাম, আমাদের দেশের মত ছয় তাকবীরে নামাজ হয়।
সত্যি বলতে, নামাজের সময় আমার একবারও মনে হয়নি, আমি বিদেশে নামাজ পড়ছি। পরিপূর্ণ তৃপ্তি নিয়ে বের হয়ে এসে দীপেশকে বখশিশ দিলাম; সে আন্তরিকভাবে না চাইলে আজকে নামাজ অনিশ্চিত হয়ে যেত কারণ আমাদের সকালে যাবার কথা ছিল বাতাসিয়া লুপ, কেবল নামাজের জন্য সে কাছ থেকে ঘুরিয়ে এনেছে। আকস্মিক বখশিশ প্রাপ্তিতে দীপেশ বিহ্বল হয়ে গেল; সে সহসা বলে উঠল, “ঈদ মুবারক”!








