স্বপ্নের দার্জিলিং (Darjeeling, West Bengal, India)

স্বপ্নের দার্জিলিং (Darjeeling, West Bengal, India)
দার্জিলিং

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগের চতুর্থ বর্ষের আমরা ৩৯ জন ছাত্রছাত্রী দুজন শিক্ষকসহ শিক্ষা সফর উপলক্ষে যখন দার্জিলিং এর উদ্দ্যেশ্যে যাত্রা করেছি, সময়টা তখন ২১ এপ্রিল-২০০১, রাত ৮ টা ৩০ মিঃ। সবার মধ্যেই একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি কাজ করছিল। পরদিন সকাল ৬টায় আমরা বুড়িমারী সীমান্তে পৌঁছলাম। সীমান্ত থেকে সাড়ে ১২টার দিকে যাত্রা করে ময়নাগুড়ি, জলপাইগুড়ি হয়ে দুপুর ২টায় শিলিগুড়ি পৌঁছলাম।

শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং (Siliguri to Darjeeling)

সীমান্ত পার হয়েই আমরা ঘড়ির সময় আধাঘণ্টা কমিয়ে নিয়েছিলাম। শিলিগুড়ি থেকে দার্জিলিং প্রায় ১০০ কি.মি., কিন্তু যেতে সময় লাগবে চার ঘণ্টার মত; কারণ, পাহাড় বেয়ে উঠতে হবে। দার্জিলিং শহরটা ভূপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৭ হাজার ৫০০ ফুট উঁচু। ভাবতেই ভালো লাগছিল যে সেখানেই যাচ্ছি।

শিলিগুড়ি থেকে আড়াইটায় যাত্রা শুরু করে কিছুদূর যাওয়ার পর হটাত দেখলাম দূরে ধোঁয়ার একটা স্তূপ, পরক্ষনেই বুঝলাম ওটা মেঘে ঢাকা পাহাড়। ইতোমধ্যেই আমরা পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে শুরু করেছি; জীবনে এই প্রথম। গাড়ি যতই সামনে এগুচ্ছে, সমতলভূমি ততই নীচের দিকে চলে যাচ্ছে। একটা পাহাড়ের চূড়ার কাছে এসে গাড়ি রাস্তা ধরে অন্য পাহাড়ের গা বেয়ে উঠতে শুরু করল। 

এমনিভাবে এ পাহাড় শেষ করে ও পাহাড়। ফেলে আসা পাহাড়গুলো তখন ছোট মনে হচ্ছিল। অনেক উপরে চলে এসেছি, নীচের দিকে তাকালেই ভয় লাগছিল। আর গাড়ির জানালা দিয়ে দেখা প্রাকৃতিক দৃশ্য কত সুন্দর, তা চোখে না দেখলে ভাষায় বোঝানো যাবে না। অসংখ্য ছোট-বড় পাহাড়, বিচিত্র রকমের গাছ-গাছালি এবং দূরে পাহাড়ের গায়ে লেগে থাকা ছোট ছোট ঘরবাড়ি দেখতে দেখতে একরকম আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলাম।

একটাই প্রশ্ন তখন মনে, পাহাড় কেটে এত সুন্দর করে কিভাবে এসব রাস্তা তৈরি করা হয়েছে? তবে, এসব রাস্তায় চলাচলের জন্য কিছুটা সাহসেরও প্রয়োজন আছে; একটু এদিক ওদিক হলেই গাড়ি পড়ে যাবে শত শত ফুট নীচে।

দার্জিলিং শহর খুব বেশী দূরে নেই বুঝতে পারলাম তখন, যখন গায়ে ঠাণ্ডা হাওয়া লাগতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই জ্যাকেট, সুয়েটার গায়ে দিয়ে নিল। অতঃপর এডভেঞ্চারের প্রথম পর্ব শেষ করে সন্ধ্যে সাড়ে ৬টায় দার্জিলিং শহরে আমাদের হোটেলের কাছে পৌঁছলাম। এখানকার বাড়িঘর, হোটেল, দোকান সবকিছুই পাহাড় কেটে বানানো। অনেক দূর থেকে দেখলে মনে হবে এগুলো পাহাড়ের গায়ে আঠা দিয়ে লাগানো আছে।

হোটেল ‘নির্ভানা’ (Hotel Nirvana, Darjeeling)

দীর্ঘ ২০ ঘন্টার বাস ভ্রমণ শেষে সবাই ক্লান্ত হয়ে বিছানায় চলে গেলাম; আমাদের ঠিকানা হলো হোটেল ‘নির্ভানা’। পুরো দার্জিলিং শহর দখল করে আছে নেপাল, ভুটান এবং সিকিম অঞ্চলের অধিবাসীরা। প্রায় সবাই হিন্দিতে কথা বলে। অসংখ্য ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল-কলেজ এখানে আছে, তবে কোন বিশ্ববিদ্যালয় নেই। শহরকে কেন্দ্র করে চতুর্দিকে বিভিন্ন পর্যটন স্পটগুলো গড়ে উঠেছে।

২৩ তারিখ সকালেই আমরা চারটি জিপে করে অনেক আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে পৌঁছলাম ‘গঙ্গামাইয়া পার্কে’; অপূর্ব সেই প্রাকৃতিক দৃশ্য। জীবনে প্রথমবারের মত ঝর্ণা দেখে অভিভূত হলাম। ঝর্ণার পানিতে নামলাম, ছবি তুললাম এবং সেখানকার বোটে চড়লাম।

রক গার্ডেন (Rock Garden, Darjeeling)

rock garden

অতঃপর সবাই মিলে রওনা হলাম ‘রক গার্ডেনে’র দিকে। এখানে এসে আরো অবাক হলাম। মনে হলো যেন প্রতিটি দৃশ্য একে অপরের সঙ্গে সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। এখানকার ঝর্ণা, গঙ্গা মাইয়া পার্কের ঝর্নার চেয় প্রশস্ত; স্রোতও বেশী। খুব রিস্ক নিয়ে ঝর্নার পানির স্রোতের কাছাকাছি গিয়ে ছবি তুললাম। অতঃপর পাথরের রাস্তা বেয়ে প্রায় ২০০ ফুট উপরে চলে গেলাম। কিছুক্ষণ সেখানে থেকে নীচে নেমে জিপে করে হোটেলে ফিরলাম।

২৪ তারিখে গেলাম ‘মিরিক লেক’-এ। সেখানেই সঙ্গে নিয়ে যাওয়া দুপুরের খাবার খেলাম এবং লেকের পাড় ধরে হাঁটতে লাগলাম। লেকের জল খুব শান্ত; আশপাশ জুড়ে মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য। আমরা লেকের উপরের সেতু দিয়ে পুরো লেক ঘুরে এলাম এবং ফিরে আসব বলে বাসে উঠলাম। ফেরার পথে দার্জিলিং এর বিখ্যাত চা বাগানে নামলাম এবং কিছু ছবি তুললাম। অতঃপর প্রথমে হোটেলে এবং সেখান থেকে শপিং এর উদ্দেশ্যে মার্কেটে গেলাম। যেহেতু শহরের রাস্তাগুলোও উঁচুনিচু, সেহেতু হেঁটেই যেতে হলো।

২৪ তারিখ দিবাগত রাত অর্থাৎ ২৫ তারিখ রাত সোয়া তিনটায় ঘুম থেকে উঠলাম এবং সবাই মিলে ৪টায় রওনা দিলাম ও ৫টায় ‘টাইগার হিল’-এ পৌঁছলাম; উদ্দেশ্য সূর্যোদয় দেখব। সোয়া ৫ টার দিকে সূর্য উঠতে শুরু করল। অসংখ্য মানুষ সেখানে গিজগিজ করছে। তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রির নীচে হবে, তবু উৎসাহের কমতি নেই।

টাইগার হিল (Tiger Hill, Darjeeling)

টাইগার হিল, এ অঞ্চলের সবচেয়ে উঁচু জায়গা। কাঞ্চনজংগা এখান থেকে ১৩৫ কি.মি. দূরে। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে কাঞ্চনজংগার সাতটি চূড়ার সাত রকম কালার হয়; আগে শুধু শুনেছি, আজ দেখব। কিন্তু কপাল মন্দ; কুয়াশা থাকার কারণে তা দেখা হলো না। জয়দেব স্যার এত বেশী হতাশ হলেন যে, মনে হচ্ছিল সাধ্যে থাকলে তিনি দুহাতে কুয়াশা সরিয়ে আমাদের কাঞ্চনজংগা দেখাতেন।

টাইগার হিল থেকে ফিরে আসার পথে গেলাম ‘বাতাসিয়া লুপ’। সেখানে যেন ফুলের মেলা বসেছে। একটা বৃত্তের মত যায়গায় অনেকগুলো ফুলের বাগান। চারপাশে মহিলা বিক্রেতারা নানান পসরা সাজিয়ে বসেছে। সেখান থেকে গেলাম পাহাড় কেটে বানানো চিড়িয়াখানায়; সেখানে এটাকে বলে ‘জুওলজিক্যাল গার্ডেন’। এরপর চড়লাম ‘রোপ ওয়ে’তে। এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে দড়ির সঙ্গে আটকানো লোহার বাক্সে করে ছয়জন যেতে পারে। একই সঙ্গে প্রচণ্ড রোমাঞ্চকর ও ভীতিকর এই রোপওয়ের যাত্রা। একবার যদি দড়ি ছিঁড়ে তবে সব শেষ।

বিকেলে আমরা শপিং-এ গেলাম। দার্জিলিং-এ আজ রাতই শেষ রাত। মার্কেটে থাকতেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টিতে ভিজে মেঘের মাঝখান দিয়ে হেঁটে হোটেলে ফিরলাম।

২৬ তারিখ ভোরে দার্জিলিং শহর ছেড়ে মংপু, তিস্তা নদী এবং কালিমপং শহর হয়ে শিলিগুড়ি এলাম এবং ২৯ তারিখ ভোর ৫ টায় ঢাকায় ফিরলাম।

পুনশ্চঃ এই লেখাটি প্রথম আলোর ‘ছুটির দিনে’ ম্যাগাজিনের ১৫০ তম সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল যেটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০০২ সালের ৫ জানুয়ারি। সেই সময়ের কাচাঁ হাতের লেখাটি একইভাবে তুলে দিলাম। ছবিগুলো গুগল থেকে নিয়ে আপলোড করা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top