চাঁদের আলোয় অপরূপ টাংগুয়ার হাওড় – পর্ব ১
সারা রাত খোলা আকাশের নীচে বোটের ছাদে ঘুমিয়ে যখন ফজরের নামাজ পড়তে উঠলাম, সে সময়ে যে দৃশ্য দেখলাম তার জন্য প্রস্তত ছিলাম না; ভোরের এই দৃশ্যের বর্ণনা কেবল সাহিত্যেই মেলে। অতঃপর, ভোর ছয়টায় বেরিয়ে গেলাম জানা-অজানা নানান জায়গা দেখার আশায়; ছোট ভাই নবী আর তার স্ত্রী এক মটর সাইকেলে এবং আমি আর নবী দম্পতির ছেলে লাইয়াজ আরেক মটর সাইকেলে।
লাল শাপলার মেলা (বিকির হাওড়)
বিখ্যাত শিমুল বাগানকে বাঁয়ে রেখে আরো বেশি খানিকটা দূরে গেলে পাওয়া যায় এই অনিন্দ্যসুন্দর বিকির হাওড়, যার পুরোটা জুড়ে ফুটে রয়েছে লাল শাপলা (ভিডিও দেখুন)। এই হাওড়ের সন্ধান অনেকেই জানে না, নবীর অনুসন্ধিৎসু মন অনেক খুঁজে এসব বের করেছে।
শিমুল বাগান (Shimul Bagan Sunamganj)
যাদুকাটা নদীর পাশে জয়নাল আবেদীনের বিখ্যাত শিমুল বাগান এ মুহূর্তে সবুজে সয়লাব; এ বাগানটিই ফেব্রুয়ারিতে লাল বর্ণ ধারণ করবে। খুব সুন্দর করে সাজানো বাগানটি, এখানে প্রবেশ করতে ২০ টাকা লাগে। এ বাগানে প্রবেশ করার আগে একটি সুন্দর বাঁশ বাগান দেখেছি; কেউ এটার কথা বলে না, কিন্তু এটিও সুন্দর করে সাজানো, দেখতে ভালো লাগে।
বারিক্কা টিলা ও যাদুকাটা নদী (Barek Tila & Jadukata River)
যাদুকাটা নদীতে সাঁতার কাটার স্মৃতি আমার বহুদিন মনে থাকবে; যদিও ট্যুর অপারেটর থেকে নিষেধ করা হয়েছিল, তবু লোভ সামলানো গেল না। নদীটি এই মূহুর্তে শুকিয়ে সরু হয়ে গেছে, বর্ষায় এটি আরো ভরাট থাকে। তবে পানি এই মূহুর্তে শহীদ সিরাজ লেকের মত স্বচ্ছ, এর তীরটি সী-বীচের মত সুন্দর বালুকাময়। বারিক্কা টিলার পাশ দিয়েই বয়ে গেছে এই নদী, টিলার উপর থেকেই দেখছিলাম চারজন বাংলাদেশী বাচ্চা নদীতে বড়শি দিয়ে মাছ ধরছে; তাদের খানিকটা দূরেই বর্ডার। এই নদী বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশেই পড়েছে। প্রায় সব স্পটেই ডাব, জাম্বুরা ও অন্যান্য আইটেম পাওয়া যায়। আমরা ডাব আর জাম্বুরা খেয়ে ফিরতি পথে রওনা দিলাম।
রাজার বাড়ি
বারিক্কা টিলায় যে পাশ দিয়ে উঠেছি, তার উল্টো পাশ দিয়ে নেমেছি; নামার রাস্তাটি যেমন এডভেঞ্জারাস তেমনি বিপজ্জনক। এটি খাড়া নেমে গেছে, তবে বাইক চালকদের তাতে বিচলিত মনে হলো না। টিলার পরের গ্রামটির নাম ‘রাজাই’; কথিত আছে, এখানে আসাম থেকে এসে ‘উইক লিপ সিং’ নামে এক রাজা আবাস গেড়েছিলেন এবং এখানে তিনি রাজত্ব করেছিলেন। বাড়িটি পুরাতন হয়ে গেলেও সেখানে মানুষের বসবাস আছে, প্রথমে গেট খুলতে না চাইলেও পরে তারা শুধু ছবি তোলার জন্য খুলে দিয়েছিল। এটি দেখতে খুব আহামরি কিছু নয়।
রাজাই ঝর্ণা (Rajai Jhorna)
রাজাই গ্রামে নতুন আরেকটি স্পট পাওয়া গেছে রাজাই ঝর্ণা নামে; যদিও এটিকে ঝর্ণা বলা যাবে কিনা না নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। দূরের কোন ঝর্ণা থেকে পানি এসে পাথরের ফাঁক দিয়ে একটি ফোয়ারা বেরিয়ে এসেছে যার উচ্চতা হবে তিন ফুটের মত। সে পানি অতি স্বচ্ছ, সেখানে খানিকটা সময় অবগাহন করলাম। বর্ষায় পানি বেশী থাকে বলে বাইকাররা জানালো। এটি একবার দেখে আসা যায়, তবে এই সিজনে অনিন্দ্যসুন্দর কিছু নয়; তার চেয়ে বরং রাজাই গ্রামের রাস্তায় চলতে ধানক্ষেত আর মেঘালয় পাহাড়ের মাঝে অবস্থিত সুপারি বাগানদেখতে অনেক বেশী সুন্দর।
লাকমাছড়া (Lakmachora)
বিছানাকান্দি আর সাদাপাথরের আরেকভাই হলো লাকমাছড়া; পানি কমে গেলেও এখনো যে স্রোত আছে, তা যে কারো দেহ-মনকে আন্দোলিত করার জন্য যথেষ্ট। ঝর্ণার পানির স্রোতের মাঝে মাথা গুঁজে ঝিম মেরে পড়ে থাকার যে আনন্দ, তা অনেকেই চেখে নিচ্ছে ঘন্টার পর ঘন্টা ধরে। এই স্পটে খাওয়া চালতার আচার বোধকরি জীবনে খাওয়া সবচেয়ে স্বাদের চালতার আচার।
শহীদ সিরাজ লেক (Shahid Siraj Lake)
ফিরে আসার আগে আবার শহীদ সিরাজ লেকে গেলাম; এই লেকটি স্মৃতিতে থাকবে বহুদিন। এটিকে দেখার জন্যই হয়ত আবার টাংগুয়ায় যাব; শেষ বারের মত সাঁতরে বোটে ফিরে এলাম। ভোর ছয়টা থেকে দুপুর দুইটা পর্যন্ত মটর সাইকেলের কন্ট্রাক্ট ছিল চারশ টাকা করে, আমরা পাঁচশ করে দিয়েছি। অবশ্য স্পট কম হলে তারা আড়াইশ করে নে।
ফেরা…
ফেরার সময় ঘনিয়ে আসছে। আজ দুপুরে রান্না হয়েছে রাজহাঁস, বোট ছেড়ে দেয়ার পাশাপাশি খাওয়ার এন্তেজাম চলছে, সেই সাথে চলছে নামাজ পড়ার প্রস্ততি; সময় তখন তিনটা। ইতোমধ্যেই ট্যুর মেম্বাররা সবাই সবার আপন হয়ে গেছে; ছোট্ট স্নেহা প্রথমদিন থেকেই সবাইকে মাতিয়ে রেখেছে, তার মধ্যে কোন জড়তা নেই। শহীদ স্মৃতি কলেজের শিক্ষকদের একটি দল ছিল টিমে, তারা প্রত্যেকেই অত্যন্ত কো-অপারেটিভ। নবী আর তার স্ত্রী ততক্ষণে আপন ভাই-ভাবীর মত হয়ে গেছে। ট্যুর অপারেটর রিকু সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছে, অন্যান্যরাও সবাই মিলেমিশে যেন একাত্মা হয়ে গেছে।
সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় বোট আবার মধ্যনগর ঘাটে ফিরে এসেছে, রাতের খাবারও বোটেই সেরেছে সবাই; সেখান থেকে মোহনগঞ্জ রেলস্টেশনে আসার ব্যবস্থা হয়েছে সিএনজি অটোতে। ওস্তাদের মাইর শেষ রাইতে; তেমনই ফেরার পথে ফেরদৌসি আপার জীবন কাহিনী শুনে হাসতে হাসতে আমাদের সিএনজিটা পর্যন্ত হাওড়ে গড়িয়ে পড়ে যাচ্ছিল!
মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস (Mohanganj Express) ছেড়ে দিয়েছে রাত এগারোটায়; বড় সুন্দর এই ট্রেনটি। আসার দিন স্নেহারা আমাদের কাছাকাছি বসেছিল, আজ দূরে সিট পড়ায় ওর শেষ মুহূর্তের চঞ্চলতা দেখতে পেলাম না। লাইয়াজ গোঁ ধরেছে কল ব্রিজ খেলবে, ওকে সংগ দেয়ার জন্য তাই খেলতে হলো। ধীরে ধীরে সবার চোখ বুঁজে আসছে; নিশ্চয়ই সবার স্মৃতিতে ধরা দিচ্ছে দুই দিনের সুন্দর সুন্দর সব ঘটনাধারা। এয়ারপোর্ট স্টেশনে যখন প্রায় সবাই নেমে গেল, মনে হলো যেন বুকটা ফাঁকা হয়ে গেল; নতুন করে শ্বাস নিয়ে কমলাপুরের দিকে এগোলাম, সেই শ্বাসের সাথে মিশে আছে গত দু’দিনের অনবদ্য স্মৃতি।