চাঁদের আলোয় অপরূপ টাংগুয়ার হাওড় – পর্ব ১ | Tanguar Haor

চাঁদের আলোয় অপরূপ টাংগুয়ার হাওড় - পর্ব ১ | Tanguar Haor
চাঁদের আলোয় অপরূপ টাংগুয়ার হাওড় - পর্ব ১ | Tanguar Haor
চাঁদের আলোয় অপরূপ টাংগুয়ার হাওড় - পর্ব ১ | Tanguar Haor

হেমন্তের টাঙ্গুয়ার হাওড় (Tanguar Haor)

হেমন্তে হাওড়ে যাব, এমন পরিকল্পনা মোটেই ছিল না, কিন্তু পূর্ণিমায় হাওড় দর্শনের লোভনীয় আহবানকে কিছুতেই উপেক্ষা করা গেল না; আর বর্ষা শেষে, হাওড় গোসল সেরে গায়ের আলগা পানি ঝরিয়ে এক নীলাভ মেক-আপ করে এই সময়টায় তার বিশেষ সৌন্দর্য তুলে ধরার জন্য প্রস্তত হয়েই ছিল, আমরা গিয়ে কেবল সে সৌন্দর্য উদঘাটন করেছি। টাংগুয়ার হাওড়ের বিশেষত্বের গল্প শুনেছি অনেক, কিন্তু এটি যে কল্পনার চেয়েও সুন্দর হয়ে ধরা দিতে পারে, সে আশা ছিল না; তাছাড়া প্রিয় ছোটভাই নবীর কল্যাণে বেশ কিছু অজানা ও অদেখা জায়গা দেখার অনুভূতি এ যাত্রায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। 

এবার যাত্রাটাই অন্যরকম হয়েছে; ট্রেনে করে এত সহজে এবং বিনা কষ্টে টাংগুয়ার হাওড়ে যাওয়া যায়, এ আবিষ্কার নতুন। বংগঘুরি ট্রাভেলের এই অফার নজরে আসতেই সাথে সাথে ফোন দিয়েছিলাম; পরে জানতে পারলাম, এডমিন ‘রিকু’ আমার স্কুলের ছোটভাই। শুধু তাই নয়, সে খবর দিল, আমাদের স্কুলের (তেজগাঁও বয়েজ) আরো এক ছোটভাই ফ্যামিলিসহ যাচ্ছে এই ট্যুরে; আমাদের খুশি আর দেখে কে!

কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে দুটি ট্রেন যায় নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ; একটি হাওড় এক্সপ্রেস, আরেকটি মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস। ভাড়া ১৮৫ টাকা; হাওড় এক্সপ্রেস পুরাতন ট্রেন আর মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস নতুন ট্রেন। আমরা পুরাতনটায় গিয়েছি, নতুনটায় এসেছি। নতুন ট্রেনে জার্নির আনন্দ আমার অনেকদিন মনে থাকবে; এর কিছুই এখনো ভাংগেনি বা চুরি যায়নি।

২৯ অক্টোবর রাত সোয়া দশটায় হাওড় এক্সপ্রেস ঢাকা ছেড়ে মোহনগঞ্জ পৌঁছেছে রাত সাড়ে চারটায়। রেলস্টেশনের ওয়াশরুমে সবাই ফ্রেস হয়ে ৫ টার পর অটোতে উঠে যাই এবং পথিমধ্যে ফজরের নামাজ পড়ে নেই। একঘণ্টা পর আমরা পৌঁছাই মধ্যেনগর ঘাটে, সেখানে আগে থেকেই আমাদের বোট এসে পড়েছিল। আমরা বোটে উঠে বোট ছেড়ে দিলাম মধ্যনগর বাজারের উদ্দেশ্যে; মোট ২৯ জন মেম্বার, সাথে তিনজন মাঝি; বাজার থেকে যোগ দিবে বাবুর্চি। মধ্যনগর বাজারে নেমে নাস্তা করে বড় দুটি তাজা বোয়াল মাছসহ অন্যান্য আইটেম কিনে বোট ছেড়ে দিলাম সোয়া দশটায় এবং হাওড়ের মধ্য দিয়ে চলতে চলতে ওয়াচ টাওয়ারে পৌঁছলাম সাড়ে ১২টার দিকে। সেই থেকে লাফালাফি আর ঝাপাঝাপি শুরু; একটানা চলল, দুপুর ২ টা পর্যন্ত। 

হাওড়ের পানিতে একেকজনের মজা করার ধরণ একেকরকম; কেউ নৌকা ভাড়া করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কেউ লাইফ জ্যাকেট পরে হাওরের নীল পানিতে ঘাপটি মেরে বসে আছে, একপক্ষকে দেখলাম হাওড়ের বুক সমান পানিতে দাঁড়িয়ে চা খাচ্ছে, একজনকে দেখলাম সিগারেট খেতে; ইতোমধ্যেই সেখানে এক চাচা আর তার ছেলে ডিংগি নৌকা নিয়ে চা আর সিগারেট নিয়ে এসেছ। আমরা কয়েকজন, নৌকার উপর থেকে লাফিয়ে পড়ছি, এই মধ্যবয়সে কাজটি কঠিন হলেও নৌকার একেবারে উপর থেকেই লাফিয়েছি।

একেবারে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে নৌকায় উঠে এলাম। ছোট ছোট বাচ্চারা ডিংগি নৌকা চালাচ্ছে, তারা নানানভাবে পর্যটকদের সাহায্য করছে, বিভিন্ন গানও গেয়ে শোনাচ্ছে; এরা অত্যন্ত হেল্পফুল ও আন্তরিক। বাচ্চা মাঝিদের তাদের পাওনা বুঝিয়ে দিয়ে আমরা নৌকার মুখ ঘুরিয়ে দিলাম টেকের ঘাটের দিকে এবং সেখানে পৌঁছে গেলাম বিকেল চারটার আগে।

তার আগে নৌকাতেই সকালে কেনা বোয়াল মাছের তরকারি দিয়ে সবাই ভরপেট খেয়ে নিয়েছি, বোয়াল মাছের তরকারি ছিল অসাধারণ! এই বাবুর্চির রান্না ভাল। আজ সারাদিন ছুটি, তেমন কিছু করার নেই। যারা হোটেলে থাকবে, তারা হোটেলে চলে যাবার এন্তেজাম করছে; আমি স্থির আছি আজ বোটেই থাকব, পূর্ণিমা দেখার জন্যই না এলাম!

নীলাদ্রি লেক (Niladri Lake)

Niladri Lake, Tanguar Haor

ব্যাগ রেডি করে চলে গেলাম শহীদ সিরাজ লেক তথা নীলাদ্রি লেকে; এই অপরূপ দৃশ্য দেখার জন্য প্রস্তত ছিলাম না। ভারতের মেঘালয় পাহাড়কে পিছনে রেখে মাঝারি আয়তনের এই লেকের পানি একেবারেই নীলাভ! টলটল করছে লেকের পানি; মূহুর্তেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অবাক করা ব্যাপার, এই লেকের গভীরতা অত্যন্ত বেশী, স্থানীয়দের মতে এটি প্রায় ছয়/সাত’শ ফুট গভীর! এলাকাবাসীর বক্তব্য, এখান থেকে প্রচুর পরিমাণ পাথর উত্তোলনের ফলে এই গভীরতার সৃষ্টি হয়েছে। সাঁতার না জানলে এই লেকে নামতে হলে অবশ্যই লাইফ জ্যাকেট পরে নামতে হবে। তারপরও সতর্ক থাকা ভালো। 

এই লেকের সবচেয়ে মজার অংশটি হলো, সাঁতরে পাড় থেকে বেশ কিছুদূর গেলে যে পানি পাওয়া যায়, সেটি দেখতে আরো বেশী সুন্দর। এই লেকের মাঝ বরাবর অনেক পর্যটক একসাথে দল বেঁধে লাইফ জ্যাকেট নিয়ে ঝিম মরে বসে থাকে দীর্ঘক্ষণ ধরে। আর সৌখিন মানুষ নৌকা ভাড়া করে ঘুরে বেড়ায় পুরো লেক। এটি একটি অনিন্দ্যসুন্দর লেক; এর পিছন দিকে মেঘালয়য়, ডান দিকে রাস্তা চলে গেছে যাদুকাটা নদীর দিকে আর বামে ছোট ছোট টিলা। সেই টিলার উপর নানান দ্রব্যের দোকান আছ। লেক থেকে সাঁতার কেটে উঠে সরাসরি চলে গেলাম সেই টিলায়; টিলার পিছন দিকে নীলাদ্রির একটি গোপন অংশ আছে যা রাস্তা থেকে দেখা যায় না। সেই অংশের সৌন্দর্যের তুলনা কেবল বিদেশি ছবির সাথেই হয়; বিদেশীরা এসব দৃশ্য দিয়েই তাদের ট্যুরিজমকে প্রমোট করার জন্য ব্যবহার করে। 

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে; টিলার উপর থেকে চানাচুর মাখা খেয়ে নীচে নেমে এসেছি। টেকের ঘাটে নৌকা বাঁধা আছে; সেটিই আপাতত গন্তব্য। শরীর ক্লান্ত হয়ে এসেছে; ধীরে ধীরে নৌকায় এসে ড্রেস চেঞ্জ করে মাগরিব পড়ার প্রস্ততি নিলাম; আমাদের বোট থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, মেঘালয়ের ওপার থেকে চাঁদ ধীরে উঠে যাচ্ছে তার আলো মেলবার জন্য।

টেকেরঘাট বাজার (Takerghat)

বড় পরীক্ষার সময় উপস্থিত! যে বিষয়টি এসব নৌকার সমালোচিত তা হলো টয়লেট। মাঝিরা ছাড়া প্রায় কেউ টয়লেট ব্যবহার করেনি; সবাই টেকেরঘাট বাজারে পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করেছে, আর বাকীরা চেপেচুপে রেখে হোটেলে গিয়ে কাজ সেরেছে। আমি নিরুপায় হয়ে পরিস্থিতি কি দেখতে গেলাম এবং বড় রকম বিপদে পড়লাম; এখানে খুবই নিচু হয়ে যেতে হয় কিন্তু আমার ভুড়ি থাকার কারণে কষ্ট হছিল। তবে, আমি যতটা খারাপ ভেবেছিলাম, ততটা নয়; প্যান যথেষ্ট পরিষ্কার ছিল, কেবল এখানে প্রবেশ করতে এবং বের হতে যা কষ্ট! ভিতরেও মাথার প্রায় তিন চার ইঞ্চি উপরে ছাদ; মোট কথা ঠেকা কাজ চালানো যায়। 

তবে এর চেয়েও উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এসব টয়লেটে বড় কাজ বা ছোট কাজ মানুষ যা-ই করে তা কিন্তু হাওড়ের পানিতে পড়ে এবং এতগুলি লঞ্চের যদি এই অবস্থা হয়, তবে টোটাল লেকের কি অবস্থা হয় কে জানে! সেই পানি আবার ওযু করা, প্লেট ধোয়া ইত্যাদি কাজে ব্যবহৃত হয়; এমনকি রান্নার কাজেও ব্যবহৃত হতে পারে, যদিও বাবুর্চির দাবি, রান্নার পানি ট্যাংক থেকে নেয়া হয়।

যাই হোক, আমরা যখন সন্ধ্যার আড্ডায় মগ্ন, পূর্ণিমার চাঁদ তখন তার আলো বিলাতে শুরু করেছে। রাতের খাবার যখন শেষ হলো, তখন একে একে অনেকেই বিদায় নিল, বাকি রইল কেবল ৯ জন আর মাঝিরা। আমি তোষকটা টেনে সামিয়ানার নীচ থেকে বাইরে নিয়ে এলাম যাতে করে চিত হয়ে শুয়েই চাঁদটাকে দেখতে পাই! তার জন্যই এত কিছু।

আকাশে তীব্র আলোর চাঁদ, অজস্র তারা, নৌকাগুলো তীর থেকে দূরে এসে নোঙ্গর করেছে, সেসব নৌকা থেকে নানান সুরে কোরাস গান ভেসে আসছে; এমন একটা রাতের জন্যই এই টাঙ্গুয়ার হাওড়ে এসেছি, উদ্দেশ্য যেন পূর্ণ হলো। ক্লান্তিতে শরীর অবশ হয়ে আসছে, সবক’টি বোট থেকে রঙিন আলো বেরিয়ে আসছে, এক অদ্ভুত স্নিগ্ধতা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে, একসময় গানও থেমে গেলে মোহনীয় এক নীরবতা নেমে এলো; চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই একসময় ঘুমের অতলে তলিয়ে গেলাম।

টাংগুয়ার হাওড়ে অনেক ময়লা, আবর্জনা দেখেছি; ট্যুরিস্টরাই সেগুলো নষ্ট করছে। আমরা যেন এসব বিষয়ে সতর্ক থাকি সেই আহবান ও শুভকামনা জানাচ্ছি।

.বি.দ্রঃ এটি দুই পর্বের লেখা; প্রথম পর্বটি বড় হয়ে যাওয়ায় দুঃখিত।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top