বিস্ময়কর সিঙ্গাপুর – ১ম পর্ব 

বিস্ময়কর সিঙ্গাপুর - ১ম পর্ব 

১.

পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুরকে পিছনে ফেলে দিবে, এই বক্তব্য শোনার দুই দিনের মধ্যে তাড়াহুড়া করে সিঙ্গাপুর চলে এসেছি; বাংলাদেশের পিছনে আছে, এমন দেশ দেখতে আমার ভালো লাগে না! 

অসম্ভব নিয়ম শৃঙ্খলা মেনে চলে এখানকার লোকজন, সিগন্যাল না পড়লে কেউ রাস্তা পার হয় না! এখানকার সিস্টেমই লোকজনকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করে ফেলেছে। এয়ারপোর্টে ট্যাক্সি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য আলাদা স্টাফ আছে। যাদের ট্যাক্সি লাগবে তারা লাইন ধরে দাঁড়াবে, একটা করে ট্যাক্সি আসবে একজন করে প্যাসেঞ্জার উঠবে, গোটা বিষয়টা নিয়ন্ত্রণ করছে কর্তৃপক্ষ; কল্পনা করতেও কষ্ট হয়!

ভ্যালু হোটেল থমসনে উঠেছি; হোটেলে সময় নষ্ট না করে চলে গেলাম মুস্তাফা সেন্টারে। হোটেল থেকে মুস্তাফা সেন্টার পর্যন্ত যেতে মিটারে বিল এলো ৭ ডলার ৯৪ সেন্ট। ট্যাক্সি ড্রাইভার দশ ডলার নোটের বিপরীতে যখন দুই ডলার দশ সেন্ট ফেরত দিল, তখন মনে হলো সিঙ্গাপুরের এই গল্পই আমি ইতোপূর্বে শুনেছিলাম!

মুস্তাফা সেন্টার গিয়ে প্রথমে মনে হলো টিএসসিতে এসেছি, আরো সামনে গিয়ে মনে হলো পুরান ঢাকায় এসেছি; আশেপাশের রেস্টুরেন্টগুলোর যেমন বাহারি নাম! গোটা এলাকা বাংলাদেশীদের দখলে; রবিবার সাপ্তাহিক ছুটি বলে এখানে তাদের মিলনমেলা বসেছে। কি নেই এখানে, হোটেল, রেস্টুরেন্ট, সিম-রিচার্জের দোকান, দেশে টাকা পাঠানোর সবরকম ব্যবস্থা, এমনকি এখান থেকে টাকা বিকাশও করা যায়! বাংলাদেশীদের প্রাণের মিলনমেলা হিসেবে এটা আলাদা জায়গা করে নিয়েছে, এখানেই এর বিশেষত্ব।

এখানে লোকসংখ্যা কম, শহরের সিটি সার্ভিসকে এরা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এখানে কারো হাতে যদি একটি স্মার্টফোন আর ইন্টারনেট কানেকশন থাকে, তবে যে কেউ যে কোন যায়গায় নিজেই চলে যেতে পারবে; এখানে গুগল ম্যাপে, কোন বাস কোন রোড দিয়ে যাবে, কোন মেট্রোরেল কোন লাইন ধরে যাবে, সব দেখা যায়! বড় তাজ্জব ব্যাপার!

ছেলেমেয়েরা এখানে খোলামেলা চলাফেরা করে, অধিকাংশ মেয়েই ছোট ছোট হাফপ্যান্ট পরে ঘোরে, অনেকের হাতে থাকে সিগারেট! ছেলেরাও সমানতালে হাফপ্যান্ট পরে; এদের দেখে কিছু বাংলাদেশী ছেলেও হাফপ্যান্ট পরা শিখেছে!

২.

অরচার্ড রোডকে বলা হয়ে থাকে কেনাকাটার স্বর্গ; অবিশ্বাস্য রকম সৌন্দর্য এই অরচার্ড রোডের! ট্যাক্সি থেকে নেমে হাঁটা দিলাম, রাস্তার দুই পাশে চোখ জুড়ানো ডিজাইনের বিল্ডিং এবং চোখ ধাঁধানো লাইটিং; ঈদ ঈদ মনে হয়! প্রত্যেকটি বিল্ডিংয়ের ডিজাইন অন্য বিল্ডিং থেকে আলাদা, এমন প্রতিযোগিতা আমি দুবাইয়েও দেখেছি।

গোটা অরচার্ড রোডের ফুটপাতে রয়েছে পয়সার বিনিময়ে নানান ধরনের বিনোদন; এক বুড়ো বাঁশি বাজাচ্ছে, যার ভালো লাগছে টাকা দিচ্ছে। এক যুবক ছেলে গিটার বাজিয়ে গান গাইছে, শ্রোতারা টাকা দিচ্ছে। একজন রোবট সেজেছে, বাচ্চারা প্রথমে সাইডে রাখা বাটিতে টাকা দিচ্ছে, এরপর রোবটের সাথে ছবি তুলছে।

জায়গায় জায়গায় মিকি মাউস ও অন্যান্য কার্টুন সাজানো রয়েছে, বাচ্চা থেকে শুরু করে বুড়োরা পর্যন্ত কার্টুনের সাথে ছবি তুলছে; কোন কারণ ছাড়াই অরচার্ড রোডে একটা উৎসব উৎসব ভাব রয়েছে। কিশোর কিশোরী থেকে বুড়ো বুড়ি সবাই এই রোডে সমানে সিগারেট টানছে! দুনিয়ার সব বিখ্যাত ব্র্যান্ডগুলোর শোরুম এখানে আছে! 

ঘুরেফিরে আবার সেই মুস্তাফা সেন্টার। আজ এই এলাকায় কবরের নীরবতা; আবার এক সপ্তাহ পর জমবে। বেশ কিছু চকলেট আর বাদাম কিনে বের হয়ে ধানসিঁড়ি রেস্টুরেন্টে ডিনার সারলাম। এখানকার বাংলাদেশীরা তুলনামূলক অনেক হেল্পফুল; যার কাছ থেকে মোবাইলের সিম কিনলাম, তার ব্যবহার আশ্চর্যরকম ভালো! 

গতকাল ট্যাক্সি না পেয়ে হেঁটে হেঁটে হোটেলে ফিরেছিলাম, আজ আর সেই সমস্যা নেই; রবিবারে এখানে যা তা অবস্থা হয়! এখনো পর্যন্ত কোন পুলিশ চোখে পড়েনি, পৃথিবীর বড় বড় শহরগুলির এই একই বৈশিষ্ট, বিপদ না হলে এখানে পুলিশ দেখা যায় না! আরেকটা বিষয়, রাস্তা ফাঁকা থাকলেও এখানকার লোকেরা সিগনাল না পড়লে রাস্তা পারাপারের জন্য দৌড় দেয়না; এরা কিছুটা বোকা আছে!

৩.

আমাদের যেমন শহীদ মিনার বা স্মৃতিসৌধ রয়েছে বাংলাদেশের সিম্বল হিসেবে, তেমনি সিঙ্গাপুরের রয়েছে অর্ধেক সিংহ আর অর্ধেক মাছের একটি স্কাপচার, ওরা এটাকে বলে Merlion অর্থাৎ Mermaid ও Lion এর কম্বিনেশন; সারা পৃথিবী এই সিম্বল দিয়েই সিঙ্গাপুরকে চেনে। এটি রয়েছে Raffles place নামক জায়গায়। মূর্তি প্রমোট করা আমার উদ্দেশ্য নয়, একটা দেশের ন্যাশনাল সিম্বল দেখানো উদ্দেশ্য।

এর ঠিক উল্টোদিকে রয়েছে বিখ্যাত জাহাজ বিল্ডিং; এটা হলো মেরিনা বে স্যান্ডস হোটেল! সন্ধ্যার পর এই জায়গার সৌন্দর্য সীমা ছাড়িয়ে যায়; এ সময় লেকে চলাচলরত বোটগুলো এই সৌন্দর্য বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। নানান আলোর খেলার মাঝে নানান রঙের পর্যটকের ভিড়ে মুখরিত থাকে এই অঞ্চল।

৪.

দুই দিনে ট্যাক্সিতে অনেক অর্থ ব্যায় করার পর কিছুটা সম্বিৎ ফিরে আসাতে মেট্রোরেলের কার্ড কিনেছি। কলকাতাতে যেবার প্রথম মেট্রোতে চড়ি, কম্পার্টমেন্টে ঢুকে দেখি পুরো কম্পার্টমেন্ট ফাঁকা। না দেখে আরাম করে এক লেডিস সিটে বসেছিলাম, কম্পার্টমেন্ট ভরে যাওয়ার পর মহিলারা এসে আমাদের উঠিয়ে দিয়েছিল! এখানেও একই ভুল হয়েছে; নামতে গিয়ে দেখি, এতক্ষণ রিজার্ভ সিটে বসেছিলাম; তবে এবার কেউ উঠিয়ে দেয়নি! মেট্রোতে করেই র‍্যাফলস প্লেসে গিয়েছিলাম, মেট্রোতে করেই মূল শহরে ফিরে এলাম। 

খাবার নিয়ে যে দুশ্চিন্তা করেছিলাম, সেটা দূর হয়েছে; যেখানেই ফুডকোর্ট আছে, সেখানেই ইন্ডিয়ান খাবার আছে, অতএব ঝামেলা নেই! অফিস আওয়ারে এখানকার লোকেদের মধ্যে একটা ত্রস্ত ভাব আছে, হেলেদুলে চলার কারবার এখানে নেই!

এখানকার মানুষের চেহারার মধ্যে কোন বিরক্তি বা অসন্তষ্টির চিহ্ন নেই, সবাই যার যার কাজে ব্যস্ত। ছেলেমেয়েরা খোলামেলা চলাফেরা করলেও তাদেরকে সম্পর্কের বিষয়ে অনেক আত্মবিশ্বাসী মনে হয়েছে; এর কারণ হতে পারে, তাদের এক্সপেক্টেশন্স কম কিংবা তাদের কমিটমেন্ট বেশী! বাংলাদেশের ছেলেমেয়েদের মত রাস্তার মোড়ে এরা কিলাকিলি করে না! 

হোটেলে ফেরার পথে মধ্যবয়স্ক ট্যাক্সি ড্রাইভারের দাঁড়ি আর মাথায় টুপি দেখে জিগ্যেস করলাম তিনি মুসলিম কিনা? বললেন, হ্যাঁ, স্যার। আমি বললাম, আলহামদুলিল্লাহ্‌; জবাবে তিনি বললেন, আসসালামু আলাইকুম! আমি অত্যন্ত বিগলিত হয়ে বললাম, ওয়ালাইকুম আসসালাম। তিনি জিগ্যেস করলেন, আমি কোথা থেকে এসেছি? 

তাকে জিগ্যেস করলাম, যেসব মেয়েদেরকে হিজাব পরে চলতে বা কাজ করতে দেখা যায়, তারা কি মুসলিম? তিনি বললেন, হ্যাঁ; তবে যারা হিজাব পরেনা, তাদের মধ্যেও মুসলিম আছে, বলে নিজেই হাসলেন! তিনি জানালেন, শুক্রবারে জুম্মা পড়েন মসজিদে এবং একেক মসজিদে খুতবা একেক ভাষায় হয়; মালয়, তামিল, ইংরেজী ইত্যাদি। 

অল্প সময়েই ট্যাক্সি হোটেলে এসে গেল। নামার আগে তাকে নাম জিগ্যেস করলাম; বললেন ‘রাহমান।’ বললাম, আপনার সাথে কথা বলে আমি অত্যন্ত খুশী, তিনি বললেন, তিনিও অনেক খুশী! ধর্ম বলে একটা ব্যাপার আছে, এটা যেই দেশে বোঝা যায় না, সেই দেশের মাটিতে জন্ম নেয়া একজন আবদুর রাহমানের সাথে সাক্ষাৎ যেন নিজের অন্তরাত্মার সাথেই সাক্ষাৎ; তাকে শুভকামনা জানিয়ে একটি ভালোলাগার রেশ নিয়ে রুমে ফিরলাম।

বিদ্রঃ এটি দুই পর্বের লেখা; আগামী পর্বে শেষ হবে। লেখা বড় হয়েছে বলে দুঃখিত। দেশে বা বিদেশে যেখানেই ভ্রমণ করবেন, পরিবেশ যাতে নষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top