রেইছা ঘাট থেকে পিছনে ব্যাকপ্যাক আর সামনে ভুড়ি ঝুলিয়ে হাঁটা দিলাম; তিন ঘন্টা পর নানান পাথুরে ও পাহাড়ী পথ পেরিয়ে থানকোয়াইন ঝর্ণায় পৌঁছে গেলাম, সময় তখন প্রায় রাত সাড়ে সাতটা। অর্থাৎ, দেড় ঘন্টার মত পথ অন্ধকারে টর্চ জ্বালিয়ে হেঁটেছি। ক্যাম্পিং স্পটে পৌঁছেই দেখলাম আরেক গ্রুপ তাদের তাঁবু খাটিয়ে রান্নার আয়োজন করতে বসেছে; এক নারী সদস্যকে দেখা গেল মাছ কাটছেন, পরে জেনেছিলাম, এগুলো তারা বিকেলে খুম থেকে ধরে এনেছিলেন।
এদিকে ঝর্ণার শব্দ একটানা কানে বেজে চলেছে কিন্তু অন্ধকারের জন্য ঝর্ণা দেখা যাচ্ছে না; চাঁদ তখনো আমাদের প্রতি দয়া করে ওঠেনি। ঘর থেকে বেরিয়ে ২২ ঘন্টা পরে ঝর্ণায় পৌঁছেছি, মাঝে কেবল সকালের নাস্তা আর চলতি পথে পেটে পড়েছে খেজুর আর বাদাম। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে, কিন্তু উপায় নেই; এখন আগে তাঁবু খাটানো হবে, এরপর মুরগী জবাই হবে, তারপর রান্না হবে, তারপরে গিয়ে খাওয়া। ট্যুরমেট থেকে একটা চাকু কিনেছিলাম, কোনদিন কাজে লাগেনি; আজ সেটা দিয়েই সাথে আনা মুরগীটা জবাই করে দিলাম।
এডমিন রুদ্র তার ক্লান্তিকে একপাশে সরিয়ে রেখে প্রথমে তাঁবু খাটিয়ে ফেলল। আমি এই ফাঁকে টর্চের আলোয় ঝর্ণার খুমে চলে গেলাম; আলো আঁধারিতে চপলা চঞ্চলা ঝর্ণাকে কিছুটা দেখা গেল বটে, তবে তাকে আর না ঘাটিয়ে সকালে পুরো সৌন্দর্য একবারে দেখার জন্য অপেক্ষা করে রইলাম। সেখানে ওযু করে এসে নিজের তাঁবুতে ঢুকে নামাজ আদায় করে স্বার্থপরের মত স্লিপিং ব্যাগে ঢুকলাম; অথচ তরুন- যুবারা তখন খিচুড়ি রান্নার কাজে ব্যস্ত। দুই ঘন্টা পরে ডাক পড়ল, আড়োমোড়া ভেঙ্গে ব্যাগ থেকে প্লেট নিয়ে গিয়ে রিলিফের খিচুড়ির মত করে অপেক্ষা করতে লাগলাম।
এতক্ষনে আকাশ ভেঙ্গে জোছনা নেমেছে, প্লেটটাকে পাথরের উপর রেখে সেই জোছনায় অবগাহন করতে করতে বিধাতার অনন্য সৃস্টি চাঁদের দিকে অপলক চেয়ে রইলাম। সেই জোছনা পাথরের উপর আমার মেলামাইনের প্লেটের উপরও কিছুটা ঝলকালো বৈকি; উপরে তাকিয়ে দেখছি, এক থালার মত চাঁদ, আর নীচে তাকিয়ে দেখছি এক চাঁদের মত থালা!
খিচুড়ি, মুরগীর পর আলু ভর্তা রেডি হলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই খাবার সাবাড় করলাম; পাচক হলো রুদ্র, এত সুস্বাদু রান্না কিছুতেই আশা করিনি! এই ছেলে ক্ষণে ক্ষণে প্রত্যাশা বাড়িয়ে দিচ্ছে; কেমন করে সে সারাটা পথ এত মাল-সামান টেনে এনে রাত সাড়ে দশটা অব্দি রান্না করে সবাইকে খাইয়ে পরে নিজের থালায় খাবার নিয়েছে, এই বিস্ময় পুঁজি করে রাতে ঘুমাতে গেলাম। আর এরই ফাঁকে সেরে নিলাম প্রকৃতির বুকে প্রাকৃতিক কাজ, সে আলাপে আর গেলাম না!
আমি ওয়েদার ফোরকাস্ট দেখেই গিয়েছিলাম; ভোর বেলা টেম্পারেচার ১৪ ডিগ্রি থাকার কথা, হলোও তাই। আমি গ্রুপে সতর্কও করেছিলাম, অধিকাংশই আমলে নেয়নি। যারা স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে যায়নি, তারা আসলে কেউ ঘুমাতে পারে নি। এর একটা বড় কারণ, আমাদের তাঁবুগুলোতে স্লিপিং ম্যাট ছিল না, ফলে মাটি থেকে যে ঠান্ডা আসছিল, তা আর সইবার মত ছিল না।
ফজরের নামাজ পড়তে উঠে দেখি আমার বন্ধু সাজ্জাদ আগুন জ্বালিয়ে আগুন পোহাচ্ছে, সাথে রাতে ঘুমাতে না পারা আরো কয়েকজন। সহসাই চোখে ধরা দিল থানকোয়াইন ঝর্ণা; আহা! আমার একশত ঝর্ণার পরিচিতিতে এর কথাই বলেছিলাম। এত পানি পাব, মোটেই আশা করিনি। উপর থেকেই দেখলাম, ঝর্নার খুমের পানি অতি স্বচ্ছ। এই ঠান্ডার মাঝেও গোসল করার দুঃসাহসী বাসনাটা উঁকি ঝুঁকি দিতে লাগল।
ধীরে ধীরে সবাই জাগতে শুরু করেছে, আসরও জমতে শুরু করেছে। রুদ্র ঘুমিয়েছে হ্যামকে, কষ্ট হয়েছে নিঃসন্দেহে। তারপরও উঠে সে স্যুপ নুডুলস রান্নার কাজে মনোনিবেশ করেছে; বাসায় এই খাবারটাকে আমি বলি, স্যুডুলস! তাকে জিগ্যেস করে জানলাম, স্যুডুলস হতে আরো সময় লাগবে, এই ফাঁকে আমি আর এ লেভেল দেয়া ফারদিন ঝর্ণার খুমে ঝাঁপিয়ে পড়লাম; এখানে গোসল না করাটা আফসোস হয়ে থাকুক, তা কিছুতেই চাইছিলাম না।
(চলবে)