গিয়েছি | খরচ | থেকেছি | অবশ্যই নিবেন |
---|---|---|---|
জন | /- | দিন |
সুন্দরবনের কচিখালিতে যখন রোজার ঈদের নামাজ পড়তে দাঁড়িয়েছি, আক্ষরিক অর্থেই তখন ভয়ে বুক কাঁপছিল, কখন পিছন থেকে এসে বাঘে ধরে নিয়ে যায়! ঘটনা ২০০৫ সালের নভেম্বর মাসের, বাংলাদেশে আধুনিক ট্যুরিজমের সূচনালগ্নের কথা। তখন এখনকার মত অনলাইন ট্যুরিজম ছিল না, ছিল সব অফলাইন ট্যুর গাইড; এক নম্বরে ছিল গাইড ট্যুরস এবং দুই নম্বরে ছিল বেঙ্গল ট্যুরস। আমি বেঙ্গল ট্যুরস এর সাথে ৫,৫০০ টাকার প্যাকেজে চার রাতের জন্য গিয়েছিলাম চির সবুজ সুন্দরবনে।
গ্রামের বাড়ির বাইরে ঈদ করার কালচার একটু একটু করে শুরু হয়েছিল তখন, আগে যেখানে ভাবাই যেত না, বাবা-মাকে ছেড়ে ঈদ করব, সেখানে কিছু পরিবর্তন এসেছিল; ফলে সিঙ্গেল, ডাবল আর ফ্যামিলি মিলিয়ে মোট ২২ জনের একটি টিম হয়ে গেল। সাংবাদিক থেকে ডাক্তার সবাইকে একসাথে পাওয়া গেল; সবাই মিলে গিয়ে উঠলাম এমভি ভেলায়, জাহাজের লোকরা বলছিল, কিছুদিন আগেই এই ভেলাতে করেই চঞ্চল চৌধুরী গ্রামীনফোনের বিখ্যাত হওয়া এডটা করে গেছে।
ঢাকা থেকে খুলনা পর্যন্ত যাত্রাপথে ছোট্ট ঐশী সবাইকে মাতিয়ে রেখেছিল, লঞ্চে উঠেও তার ব্যতিক্রম নেই। লঞ্চে উঠে ফ্রেশ হয়ে ডেকে গিয়ে বসলাম, সূর্যটা ধীরে ধীরে পশ্চিমে হেলে পড়ছে। আমাদের লঞ্চটাও পশ্চিমে ছুটে চলেছে, যেন অস্তগামী সূর্যটার অস্ত যাবার আগেই তাকে ধরার প্রাণান্ত চেষ্টা।
পরিচয়ের পরিধিটা একটু একটু করে বাড়ছে। যেহেতু ঈদ আরো একদিন পরে, সন্ধ্যায় সবাই কাছাকাছি এলো ইফতার করার জন্য। রাতে খাওয়ার আগে পরিচয় পর্ব শুরু হলো। ইতোমধ্যেই কমবেশী সবাই জেনে ফেলেছে যে, লঞ্চে শাহীন নামে এক দুষ্ট যুবকের আবির্ভাব ঘটেছে, তবে তাদের শঙ্কিত মনে হলো না; তখনো বিয়ে করিনি, বিয়ে করেছি পরের বছর।
খুলনার জেলখানা ঘাট থেকে ছেড়ে লঞ্চ রূপসা নদী হয়ে পশুর নদী পেরিয়ে মংলারও পরে মিরিগমারি ফরেস্ট অফিসের কাছে নোঙ্গর ফেলেছে। রাত যত গভীর হচ্ছে, আকাশের তারকারাজি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে। চারিদিকের নিস্তরংগতার মাঝে আকাশের মিটিমিটি তারাগুলো ভাবনায় কিছুটা আলোড়ন তুলছিল; কেউ গাইছিল, আকাশের ঐ মিটিমিটি তারার সাথে কইব কথা, কেউবা, নীল চাঁদোয়া, আকাশটাকে আজ লাগছে যেন, মাঝে মাঝে কিছু কিছু তারা বোনা-বৃষ্টি ধোয়া, আবার কেউ গাইছিল, কত তারা আকাশে কত তার নীল, চোখের আকাশ নীলে সুখ অনাবিল, ইত্যাদি।
শুরুতেই কটকা যাবার সিদ্ধান্ত থাকলেও কচিখালিতে যেহেতু একটি ঈদের জামাত হয়, তাই কচিখালিতেই যাবার সিদ্ধান্ত হলো। যেতে যেতে জনপ্রিয় আংকেল-আন্টি জুটির আংকেল গোলপাতা, গোলগাছ চিনিয়ে দিলেন এবং আরো চিনিয়ে দিলেন সুন্দরী গাছ। দূরবীন দিয়ে পশুপাখি দেখার প্রাণান্তকর চেষ্টা চলছে কমবেশি সবার, কিন্তু সাফল্য এখনো ধরা দেয়নি। জাপানিজ দম্পতি বেশ উপভোগ করছে এই ট্যুর। ঐশীর আব্বু-আম্মুর সার্বক্ষণিক চেষ্টা আছে তাকে কিছু না কিছু খাওয়ানোর। এই দেখতে দেখতেই মাথায় একটা আইডিয়া খেলে গেল; আচ্ছা, শেষদিন একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান করলে কেমন হয়!
ইতোমধ্যেই সকালে যাত্রা করে শ্যালা গাং হয়ে, পাঁজরাফুটা, হরিণটানা, দুধমুখী এবং সুপতি পেরিয়ে কচিখালিতে নামার অপেক্ষা; সময় তখন দুপুর আড়াইটা, পরের দিন ঈদ-উল ফিতর। সিদ্ধান্ত হলো সবাই মিলে জঙ্গলে ঘুরতে যাব, উদ্দেশ্য বাঘ দেখা, যেন বাঘ দেখতে পেলে খুব আনন্দের ব্যাপার ঘটবে! যে দুজন লোক রাইফেল নিয়ে এসেছে সাথে, তারা যে বাঘ দেখার সাথে সাথে দৌড় দিবে তা হলফ করে বলে দেয়া যায়! জঙ্গলে যাবার আগে কচিখালি মসজিদের ইমাম সাহেবের সাথে দেখা হয়েছে, ওনাকে বললাম, জঙ্গলে যাচ্ছি, যদি বেঁচে ফিরি, তবে কাল ঈদের নামাজে দেখা হবে।
নানান ক্যারিকেচারের মধ্য দিয়ে দিনটা পেরিয়ে গেল। ইফতারের পর অপেক্ষা করতে লাগলাম, ঈদের খবরের জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই সংবাদ এলো, কাল ঈদ; সবাই আনন্দে চিৎকার করে উঠলো। এরপর শুরু হলো হেঁড়ে গলায় গান, অনেকগুলো গান গাইলাম আমি। এরই ফাঁকে ফাঁকে চলতে লাগল ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা।
পরদিন ঈদের নামাজ পড়ে, কটকার দিকে আগালাম। রাত নাগাদ কটকায় পৌঁছে নোঙ্গর ফেললাম। তার কিছুক্ষণ পরেই গাইড নান্নু ভাইয়ের কাছ থেকে অফারটি এলো চুপি চুপি, গভীর রাতে হরিণ দেখতে বের হব। যুবকরা রাজি হয়ে গেল, সবাই যখন ঘুমে তখন আমরা ডিঙ্গি নৌকাটা নিয়ে রাত ১২ টার দিকে নেমে গেলাম পানিতে। তীরের কাছাকাছি গিয়ে যে দৃশ্য দেখলাম, তা এই জীবনে ভুলব না; চারটি হরিণ পানি পান করছিল, আমাদের আওয়াজ পেয়ে তারা যখন চোখ তুলে তাকিয়েছে, চার জোড়া চোখ জ্বলজ্বল করছিল, পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর দৃশ্য ছিল এটি।এরপর জংগলে গিয়ে হরিণকে ধাওয়াও দিয়েছিলাম।
পরদিন কটকা বীচে ফুটবল খেলে, সাঁতার কাটতে নেমেছিলাম; ভয় ভয় করছিল, কারণ তার কিছুদিন আগে এখানে খুলনা বিআইটি’র ১১ জন ছাত্র মারা গিয়েছিল। যাই হোক, বিকেলে আমরা বেরিয়েছিলাম ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে সুন্দরবনের খালে এবং দেখেছি ম্যানগ্রোভ অঞ্চল ও নানান জাতের পশুপাখি।
চার রাতের সেটিই ছিল শেষ রাত; সবাই জেনে গেছে আজ ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান হবে। আমার উপস্থাপনায় দেড় ঘণ্টার একটি ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান হয়ে গেল; জীবনের অন্যতম সুন্দর অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে এটি ছিল একটি। কেবল পুরষ্কার কেনার ব্যবস্থা ছিল না বলে, পুরষ্কার দেয়া গেল না।
পরদিন সকালে জাহাজ মংলা বন্দরে নামিয়ে দিয়ে গেলে, আমরা ঢাকার পথ ধরলাম। ২২ জন মানুষ এই চারদিনে যেন একাত্মা হয়ে গিয়েছিল; আমি নামার সময় ঐশী ভীষণ কান্না করছিল, ও আমাকে কিছুতেই নামতে দিবে না। তারপরও সময়ের প্রয়োজনে সবার মায়া ফেলে সবাই যার যার গন্তব্যে ফিরে গেছে; পিছনে রেখে গেছে কিছু অনবদ্য স্মৃতি।