স্বপ্নাতুর ও ব্যাথাতুর আমিয়াখুম-নাফাখুম (প্রথম পর্ব)

স্বপ্নাতুর ও ব্যাথাতুর আমিয়াখুম-নাফাখুম (প্রথম পর্ব)
নাফাখুম

দেবতাখুম ঘুরে এসে তার আগে ‘অপার্থিব’ বিশেষণটি লাগিয়েছিলাম, আমিয়াখুম এবং নাফাখুম ঘুরে এসে এগুলোর সাথে লাগানোর জন্য তাই বিশেষণ সংকটে পড়েছি; বোধকরি ‘স্বর্গীয়’ বিশেষণটি খুব যথার্থ হয়! একটি ট্যুরে আল্লাহ্‌ রাব্বুল আ’লামিন অনেক অভিজ্ঞতা একবারে নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন; পূর্ণিমা রাতে নাফাখুমের সৌন্দর্য দেখার সুযোগ সবার হয় না, সে সুযোগ পেয়েছি (প্রথম ছবি; তুলেছেন অপু ভাই)!

বনজঙ্গল, ঝিরিপথ আর পাহাড় ডিঙিয়ে কেবল পূর্ণিমার আলোয় সোয়া পাঁচ ঘন্টা হেঁটেছি জিন্নাপাড়ায় পৌঁছাতে, এর মধ্যে কোমর সমান পানিও পেরিয়েছি অবলীলায়! শখ ছিল আমিয়াখুমে ঝাপ দিব, এডমিনের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে তাও করেছি, পুরো আমিয়াখুম এ-মাথা ও-মাথা সাঁতরেছি। ফেরার পথে এক জায়গায় পা পিছলে উপর থেকে নীচে পড়ে ডিগবাজি খেয়ে কাঁদার মধ্যে দেবে গেছি; আরো কত কি!

২৬ নভেম্বর রাত সাড়ে এগারোটায় ঈগলের এসিতে করে রওনা দিয়েছি ভ্রমণপোকা গ্রুপের সাথে, টোটাল মেম্বার ১৭ জন। সকাল ৭ টায় বান্দরবান পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে চান্দের গাড়িতে রওনা দিলাম থানচির উদ্দ্যেশ্যে; মিলনছড়ি বিজিবি ক্যাম্পে নাম এন্ট্রি করে রওনা দিয়েছি আবার; এখানে বিজিবির একটি অতি সুন্দর ক্যাফেটেরিয়া আছে এবং আছে খুব সুন্দর করে সাজানো একটি এলাকা। মিলনছড়ির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সাথে পাল্লা দিয়েই এটিকে সুন্দর করা হয়েছে। দেখলাম, সকালের সূর্য গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে, দূরে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মেঘের আবরণ, নীচের পাহাড়গুলোকে পরম আদরে আগলে রেখেছে, সূর্য যত উপরে উঠবে, মেঘ তত আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠবে; আমাদের অনভিজ্ঞ চোখে সেটি দেখতে বড় অবাক করা দৃশ্য।

বান্দরবান থেকে থানচি, প্রায় আশি কি.মি. রাস্তা চান্দের গাড়িতে তিন ঘন্টায় পৌঁছে, নামাজ পড়ে দুপুরের খাবার খেয়ে এবং বিজিবি’র ফর্মালিটি শেষ করে সাঙ্গু নদীর ঘাট থেকে রেমাক্রির উদ্দেশ্যে নৌকায় উঠতে ২:৩০ বেজে গেল। শীতকাল বলে সাঙ্গুর পানি এখন একেবারে তলানিতে, দক্ষ নাবিক নৌকাকে ঝড়ের গতিতে টেনে নিয়ে গেল নানান বিপদজনক বাঁক পার করে। তিন্দু চেক পোস্ট পার হয়ে আমরা ঢুকে গেলাম বড়পাথর এলাকায়; সেখানে অনেক পাথরের মাঝে দেখলাম বিখ্যাত রাজাপাথর, শুনেছি, সেখানকার লোকজনের কাছে এই এলাকাটি খুবই পবিত্র।

রেমাক্রি জলপ্রপাতের কাছে গিয়ে নৌকা যখন থেমেছে তখন ঘড়িতে ৪:৩০ বাজে, দূর থেকে দেখলাম, জলপ্রপাতের উপর বসে আছেন অনেক পর্যটক, শীতল পানিতে শরীরকে ভিজিয়ে নিচ্ছেন শেষবারের মত। আমাদের সেখানে যাওয়া বারণ বলে হাঁটা দিলাম জিন্নাপাড়ার দিকে। কোন ট্যুরেই দেখলাম না, কেউ সত্যি কথা বলে; না ট্যুর অর্গানাইজার না ট্যুর গাইড। যখনই জিগ্যেস করি, আর কতদূর? বলে এইতো আর ২০ মিনিট। মূল কথা হলো, ঢাকা থেকে বান্দরবান গাড়িতে আট ঘন্টা, বান্দরবান থেকে থানচিতে চান্দের গাড়িতে তিন ঘন্টা, থানচি থেকে নৌকায় রেমাক্রি কমবেশী দুই ঘন্টা, রেমাক্রি থেকে নাফাখুম হেঁটে তিন ঘন্টা, নাফাখুম থেকে হেঁটে জিন্নাপাড়া তিনঘণ্টা এবং জিন্নাপাড়া থেকে হেঁটে আমিয়াখুম তিন ঘন্টা; মোট ২২ ঘণ্টার জার্নি এবং ফিরতি পথে ২২ ঘণ্টাসহ মোট ৪৪ ঘণ্টার জার্নি, মোটামুটি এটাই পাক্কা হিসাব আমজনতার জন্য। যারা যাবেন, বুঝে যাবেন।

বিকেল সাড়ে চারটায় হাঁটা শুরু করে যে যাত্রার শুরু, তা এভাবে শেষ হবে কল্পনাও করিনি; জিন্নাপাড়ায় যাবার টার্গেট, অর্থাৎ ৬ ঘণ্টা হাঁটতে হবে। এর মধ্যে ৪৫ মিনিট হাঁটার পর সন্ধ্যে হয়ে গেছে, বাকি সোয়া ৫ ঘন্টা কেবল চাঁদের আলোয় টর্চ জ্বালিয়ে পথ চলতে হয়েছে। সেই পথে আছে উঁচু-নীচু পাহাড়ী রাস্তা, অসংখ্য ঝিরি যেগুলোর একটিতে কোমর পর্যন্ত পানি, আছে জংগল। তিন ঘন্টা হেঁটে নাফাখুম পাওয়া গেল; চাঁদের আলোয় নাফাখুম দেখতে লাগছিল একেবারে স্বর্গীয়। বেশীক্ষণ বসা গেল না, ক্লান্তির কারনে একবার নাফাখুমে থেকে যেতে চেয়েছিলাম, নাছোড়বান্দা এডমিন লাভলু ভাই সেই সুযোগ দিল না; টেনে হেঁচড়ে নিয়ে চলল। নাফাখুমে একটি সিদ্ধ ডিম ২০ টাকা, একটি বাংলা কলা ৫ টাকা এবং এক লিটার পানি ৫০ টাকা।

শরীরের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসছিল, পা থেমে যাচ্ছিল; এর মধ্যে পায়ের গোড়ালিতে ব্যাথা থাকায় আমি একটি নরম স্পঞ্জ এর স্যান্ডেল পরে হাঁটছিলাম। জিন্নাপাড়ায় ওঠার যে শেষ সিঁড়িটা আছে তাঁর মাঝখানে গিয়ে একেবারে থেমে গেছি, দুই একজন অতিমানব বাদে প্রায় সবারই একই অবস্থা। শেষ পর্যন্ত জিন্নাপাড়ায় উঠে নিজেদের ঘর খুঁজে পেলাম; এই শীতের মধ্যে রাত এগারোটায় গোসল করে খেয়ে ক্লান্ত শরীর নিয়ে নামাজ পড়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। পুরো সময় আমাদের গাইড হিসেবে ছিল সেবাস্টিন ত্রিপুরা এবং তাকে এসিস্ট করেছে শিমন; অসম্ভব কোমল হৃদয়ের অধিকারী এই দুজন মানুষ। 

পুনশ্চঃ টিওবিতে অধিকাংশ লেখাই দেখি খরচ সংক্রান্ত বা রুট প্ল্যান সংক্রান্ত; আমি যেহেতু একা মানুষ তাই গ্রুপে ট্যুর করি, ফলে আমার খরচ এককালীন। তাই ভ্রমণের কাচাঁ বর্ণনাই আমার লেখার সঙ্গী; সেটুকু মার্জনা করবেন।

পরামর্শঃ এই ট্যুরে গেলে ব্যাগ হালকা রাখার চেষ্টা করবেন। সাথে শুকনা খাবার নেয়ার দরকার নেই, সেখানে যেসব দোকান আছে, তাতে ডিম সিদ্ধ, কলা, বিস্কুট, ড্রাই কেক ও চা পাওয়া যায়। অবশ্যই ভালো মানের ট্র‍্যাকিং স্যান্ডেল নিয় যাবেন। অবশ্য ১২০ টাকা করে সবাই থানচি থেকে যেটা কিনেছে, তাতেও ভালো কাজ চলে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top