স্বপ্নাতুর ও ব্যাথাতুর আমিয়াখুম-নাফাখুম (দ্বিতীয় পর্ব)

স্বপ্নাতুর ও ব্যাথাতুর আমিয়াখুম-নাফাখুম (দ্বিতীয় পর্ব)
নাফাখুম

স্বপ্নাতুর ও ব্যাথাতুর আমিয়াখুম-নাফাখুম প্রথম পর্বের লিংক

আমিয়াখুমে উপর থেকে ঝাপ দিব, সে সিদ্ধান্ত নেয়াই ছিল, কিন্তু কাউকে সাথী না পেয়ে এবং এডমিনের বাধা পেয়ে কিছুটা দমে গেলাম; তবে শেষ পর্যন্ত একটু নীচু পাথর থেকে হলেও ঝাপ টা দিলাম! যে পাশে জলপ্রপাতের পানি পড়ে তার উল্টোদিক থেকে একাই সাঁতরে জলপ্রপাতের নীচে আসতে চাইলাম। কিন্তু কাছাকাছি আসতেই দেখি আর আগাতে পারছি না, যতই সাঁতরাই, এক জায়গাতেই থাকছি। অর্থাৎ, স্রোতের বেগ আর আমার বেগ একই! শেষ পর্যন্ত রনে ভংগ দিয়ে পিছালাম, বেশ কিছুক্ষণ পাশের পাথর ধরে থাকার চেষ্টা করলাম, পিচ্ছিলতার কারনে না পেরে অবশেষে আবার খুমের অপর মাথায় চলে গেলাম।

সকাল নয়টায় জিন্নাপাড়া থেকে রওনা দিয়ে ১২ টায় আমিয়াখুম পৌঁছলাম। এর মধ্যে পেরিয়েছি আলোচিত দেবতা পাহাড়; যখনি কেউ এর সম্পর্কে বলবে, শুনবেন, এটি ৯০° খাড়া একটি পাহাড়। মোটেই তা নয়, তিন কি চারটি জায়গায় এটি প্রায় ৮০° খাড়া তাও সেই অংশগুলোর উচ্চতা দশ ফুটের বেশী নয়। নইলে এত হাজার হাজার ট্যুরিস্ট এটি পার হতে পারত না; তবে, মোটের উপর এটি একটি খাড়া পাহাড় এবং পাড়ি দেয়া কষ্টকর। 

আমিয়াখুমে প্রচুর পর্যটকের আনাগোনা, কমবেশি সবাই ব্যস্ত ছবি তোলায়। আমি খুম থেকে উঠে এসে জলপ্রপাতের একেবারে উপরের অংশে আবার ডুবে গেলাম। ঠান্ডা পানির স্রোতের নীচে মাথা ডুবিয়ে শুয়ে থাকার পরম তৃপ্তি অনুভব করলাম দীর্ঘসময় জুড়ে।

অওঃপর, আমিয়াখুম থেকে ৫ মিনিট হেঁটে ভেলাখুমে গেলাম; সেখানে ভেলায় চড়লাম। এই ভেলাগুলো বড়, একসাথে ৫ জন ওঠা যায়, এখানে ভেলা চালানোর জন্য মাঝি আছে। তবে, দেবতাখুমে ভেলা নিজেকেই চালাতে হয় এবং ওঠা যায় মাত্র একজন বা দুজন। ভেলাখুমের পানি সবুজাভ, দুপুরের সূর্যের আলো পড়ে সেখানে এক সুন্দর দ্যোতনার সৃষ্টি করেছে। এর শেষ মাথায় রয়েছে নাইখংমুখ, এটি বিশেষ কিছু নয়, কেবল ঝর্ণার দুটি স্রোতধারা। ভেলাখুমে শেষবারের মত সাঁতার কেটে, ড্রেস চেঞ্জ করে জিন্নাপাড়ার দিকে রওনা হলাম।

রাতটা জিন্নাপাড়ায় কাটিয়ে পরদিন ভোর সাড়ে ছয়টায় ফিরতি পথে রওনা দিলাম। তিন ঘন্টা পর নানান ঝিরি আর সকালের কুয়াশা পেরিয়ে নাফাখুম পৌছলাম সাড়ে নয়টায়। তন্ময় হয়ে নাফাখুমের সৌন্দর্য ও এর বিশালতা দেখে আবার হাঁটা দিলাম রেমাক্রির দিকে। এই পথেই দুর্ঘটনাটা ঘটলো, খাড়া এক জায়গায় নামতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে ডিগবাজি খেয়ে একেবারে কাদায় দেবে গেলাম; আল্লাহর রহমতে খুব বড় কোন চোট পাইনি।

রেমাক্রি জলপ্রপাতের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এটি অনেক চওড়া এবং অগভীর। এখানে উপরে বা নীচে বসে অনায়াসে পানিতে ভেজা যায়। উচ্চতা কম হলেও এখানে পানির স্রোতের তীব্রতা একেবারে কম নয়। এখানে প্রায় সবাই গা ভিজিয়েছে; উদ্দাম আনন্দ বলতে যা বোঝায় তা হয়েছে রেমাক্রি ফলসে। আমি নাফাখুমে নামতে চেয়েছিলাম, কিন্তু এটি পিচ্ছিল বলে এবং কোন সংগী না পেয়ে ইস্তফা দিয়েছিলাম।

অতঃপর, আসর ভংগ করে রেমাক্রি থেকে নৌকায় থানচি ফিরে বিখ্যাত পেটুক হোটেলে পেটুকের মত খেয়ে চান্দের গাড়িতে বান্দরবান ফেরত এলাম। তারপর রাতের গাড়িতে ঢাকার পথ ধরে ভোর ৫ টায় ঢাকায় নামলাম। 

আজ তিনদিন হয়ে গেল ফিরে এসেছি, কিন্তু কিছুতেই এই ট্যুরের স্মৃতি ভুলতে পারছি না; ক্ষণে ক্ষণে মনে পড়ছে চালকুমড়ার লাবড়ার কথা, অসম্ভব স্ট্যামিনা নিয়ে সবার আগে আগে শতাব্দী আপুর ক্লান্তিহীন হেঁটে চলা, হৃদয় ভাইয়ের বিখ্যাত নাক ডাকা, লাভলু ভাই আর তন্ময় ভাইয়ের দায়িত্ববোধ, আক্তার ভাই আর পলাশ ভাইয়ের মজার মজার কথা, শায়লা আপার জন্য অপু ভাইয়ের সযত্ন সাপোর্ট, খুবই কাছের মানুষ হয়ে যাওয়া ছোটভাই রনি ও তার ভাই-ভাবি, এছাড়াও বাশার ভাই, বীথি আপাসহ অন্যান্যদের কথা। আর চোখে ভাসছে যে বাড়িতে ছিলাম, তাদের হাফপ্যান্ট ছাড়া ছেঁড়া গেঞ্জি পরা ছোট ছেলেটির কথা।

এতসব আবেগের আর স্বপ্নাতুর কথা বলে, এই লেখার হেডলাইনে কেন ব্যাথাতুর দিলাম? কারণ, সারা শরীরে ব্যাথা! একেতো পড়ে গিয়ে তলদেশে ব্যাথা পেয়েছি, তা ছাড়াও এক পায়ের গোড়ালিতে পাথরের বাড়ি খেয়েছি, দুই হাঁটুতে ব্যাথা ছিল, মাসল ব্যাথা তো ছিলই; সুতরাং ব্যাথাতুর না লিখে উপায় ছিল না। (সমাপ্ত)

পরামর্শঃ 
১. এই ট্যুরে মেয়েদের নিয়ে বেশী দুশ্চিন্তা করবেন না, মনে হবে এই মেয়েটা খুব বিপদে পড়েছে, সে কিছুতেই যেতে পারবে না ইত্যাদি ইত্যাদি; ভুল! আপনি নিজেকে নিয়ে ভাবুন, নইলে দেখবেন, সব মেয়েই পৌঁছে গেছে, আপনিই পিছনে রয়ে গেছেন। এখানে মেয়েরা এক অন্যরকম শক্তি নিয়ে যায়!
২. আমি সাথে ক্লোফেনাক জেল, আইসিকুল ম্যাক্স এবং নাপা এক্সটেন্ড আর নাপা এক্সট্রা রেখেছিলাম, এগুলো ভীষণ উপকারে এসেছে।
৩. ভালো গ্রিপের জুতা, এংকলেট ও নি-গার্ড খুব উপকারি, নিয়ে নিতে পারেন। ওয়াটারপ্রুফ মোবাইল কাভার জরুরী জিনিস, সাথে পাওয়ার ব্যাংক ও টর্চ অবশ্যই।
৪. ব্যাগ ভারী করবেন না কিন্তু গোসল করার জন্য কিছু কাপড় অবশ্যই নিবেন। একটি লুংগি বা গামছা অবশ্যই নিতে হবে।
৫. শরীরে কারেন্ট বেশী না থাকলে ভুলেও পদ্মঝিরি দিয়ে যাবেন না, যাবেন রেমাক্রি দিয়ে। পদ্মঝিরির রাস্তা বেশী কারেন্টওয়ালাদের জন্য।
৬. আর হ্যাঁ, মিলনছড়ির বিজিবি চেকপোস্টের ক্যাফেতে জলপাইয়ের জুস খেতে ভুলবেন না। এক গ্লাস মাত্র ৩০ টাকা।

পুনশ্চঃ অমায়িক গাইড সেবাস্টিন ও তার এসিস্ট্যান্ট শিমনের কথাও ভুলতে পারছি না। সেবাস্টিনের নাম্বার হলো +8801585838882.

সতর্কতাঃ দেশে বা বিদেশে যেখানেই ভ্রমণ করবেন, খেয়াল রাখবেন আপনার কারনে যেন সেখানকার পরিবেশ নষ্ট না হয়। হ্যাপি ট্রাভেলিং।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top