শুধুমাত্র কনসেপ্ট সেল করে যে একটা বিরাট ক্রেজ তৈরি করা যায় এবং দিব্যি ব্যবসা করা যায়, তার অন্যতম উদাহরণ হলো, ‘ঠিকানা ডে আউটার্স’; ঠিকানা রিসোর্ট নামে যেটি অধিক পরিচিত।
ঠিকানা রিসোর্টের লোকেশন কোথায়? কিভাবে গেলাম?
- ঠিকানা: ১০০ ফিট, মাদানি এভিনিউ, বড় বেরাইদ, বাড্ডা, ঢাকা -১২১২
- সকাল ১১:০০ থেকে রাত ১০:০০ (প্রতিদিন)
ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে ১৮-২০ কিলো দূরে এবং বেরাইদ বাজার থেকে দুই কিলো দূরে এর অবস্থান; একেবারে গ্রামীণ পরিবেশে একটি শহুরে স্থাপনার নাম হচ্ছে ঠিকানা।
এখানে প্রাইভেট গাড়ি ছাড়া আসা কষ্টের; নিদেনপক্ষে ভাড়া করা গাড়ি বা উবার কিংবা মটর সাইকেল হতে পারে। কোন বাস এ রুটে চলে না, এমনকি কোন সিএনজি অটোও চলতে দেখিনি।
কনসেপ্ট সেলিং বললাম, কারণ, এটি একটি দর্শনীয় স্থান যেটি বহুল পরিচিত বাহারি ফুলের কারনে, কিন্তু সেখানকার মূল ব্যবসা হলো খাবার! এখানে আসলে বাহারি ফুল নেই, আছে একটি মাত্র ফুল যার নাম ‘পিটুনিয়া’, রয়েছে তার বাহারি রঙ; লাল, বেগুনী, লাইট পিংক, সাদা মূলতঃ এই চার রঙের পিটুনিয়া ঘিরে রেখেছে ঠিকানাকে।
বাহারি ফুলের শহীদ মিনার
সম্প্রতি পত্রিকায় কি একটা নিউজ হয়েছে; ঠিকানায় ফুল দিয়ে একুশ লেখা হয়েছে বা এমন কিছু একটা, স্ত্রীর উৎসাহে এবং অবশ্যই নিজের আগ্রহে গতকাল শুক্রবার ঠিকানায় যাওয়া। গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকে বুঝতে পারছিলাম না, কোথায় এসে পড়লাম; চারদিকেই ফুল, বিল্ডিংগুলো সব একই ফুলের নানান রঙ দিয়ে সাজানো।
ধীরে ধীরে এগোলাম, বিকেল সোয়া চারটায় এসেছি, ইতোমধ্যেই যথেষ্ট লোক সমাগম হয়েছে; ইংগিত পেলাম আরো লোক আসবে আজকে। সামনে এগিয়ে ডানে তাকাতেই দেখলাম বিরাট এক বিল্ডিং এর সামনের অংশ নানান রঙের পিটুনিয়া ফুল দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে।
ভালো করে লক্ষ্য করলাম, এগুলো আসলে শত শত প্লাস্টিকের টবে লাগানো ফুল গাছ, যেগুলো সিরিয়ালি লাগানো হয়েছে। একটু দূর থেকে দেখলে চোখে পড়ে এর মধ্যে সাদা ফুলের টবগুলো এমনভাবে রাখা হয়েছে যে, এখানে বাংলা অক্ষর ক এবং ই লেখা হয়েছে, দেখা যায় শহীদ মিনার আর দেখা যায় ঠি কা না।
কৃত্রিম লেক
এখান থেকে সামনে এগোলাম; সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়েছে, সেদিকে একটি বিরাট প্রান্তর আছে, যেমনটা আমাদের গ্রামগুলিতে দেখা যায়। এর পাশেই একটা কৃত্রিম লেক তৈরি করা হয়েছে, সেখানে মাছও ছাড়া হয়েছে; পানি কমে যাওয়ায় সেসব মাছ সহজেই দেখা যায়। বসন্তের বাতাস সেই পানিতে সুন্দর ছোট ছোট ঢেউ তৈরি করেছে এবং খোলা প্রান্তরের পাশে দাঁড়ালে বসন্তের গন্ধ মাখা খুব মোলায়েম বাতাস গায়ে লাগে।
টুকরো অভিজ্ঞতাগুলো
বিশাল এলাকাজুড়ে তৈরি করা হয়েছে ঠিকানার সীমানা। এর বিরাট একটি অংশ কাঠের পাটাতনের উপর দাঁড়িয়ে আছে, যেটি দাঁড়িয়ে আছে কংক্রিটের পিলারের উপর, আর বাকি অংশ মাটি ভরাট করে তৈরি করা হয়েছে। এখানে দুটি বিল্ডিং আছে। অন্য বিল্ডিংটি তিনতলা, যার ছাদ পর্যন্ত ওঠা যায় এবং সেখান থেকে গোটা স্থাপনাটা দেখা যায়; বড় সুন্দর লাগে।
সেই বিল্ডিংয়ের গায়ে লাইট লাগানো আছে যেটি সন্ধ্যার পর ছাড়া হয় এবং ক্ষনে ক্ষনে রঙ পাল্টে নানান রঙ ধারণ করে। এটি দেখতে বড় সুন্দর লাগে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার দিকে আগানোর মাঝেই ধীরে ধীরে ভরে উঠতে লাগলো গোটা প্রাংগন। সারা অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে আছে নানান রাস্তা, ফুলের সমাহার, নার্সারি, বাবুদের খেলার সরঞ্জাম, ছবি তোলার নানান আয়োজন, দোলনা, বেঞ্চি, চেয়ার-টেবিল, সাজানো লেক ইত্যাদি। এর সাজানো অবশ্যই প্রশংসার দাবী রাখে।
নানান বয়সের মানুষে পরিপূর্ণ এই গোটা এলাকা, অগণিত প্রাইভেট কার জড়ো হয়েছে এর বিপূলায়তন পার্কিং এরিয়ায়। প্রায় তিনদিক থেকে এটি পানিবেষ্টিত; বর্ষাকালে এর সৌন্দর্য আরো বেড়ে যায় বলেই মনে হলো। চারিদিকে থৈথৈ পানি, তার মাঝখানে কাঠের পাটাতনে আপনি হাঁটছেন, ব্যাপারটাই অন্যরকম। আর এর মাঝে যদি বৃষ্টি হয়, তবে আর কাউকে আটকে রাখা যাবে বলে মনে হয় না।
যথারীতি বিড়ম্বনা হয়েছে ছবি তোলা নিয়ে; একটা বড় সংখ্যক মানুষ এখন নতুন কোথাও যায় মনে হয় কেবল ছবি তুলতে! এই ছবি তোলার জন্য শান্তিতে কোন জিনিস দেখবারও উপায় নেই। এই জায়গায় আগে নারীদের বাড়াবাড়ি ছিল, এখন তার সাথে পুরুষরাও যোগ দিয়েছে।
অধিকাংশ নারী ছবি তোলার জন্য উদ্ভট সাজ দিয়ে এসেছে, একেবারে বিয়েবাড়ীর সাজ! ছবি তোলাকে তারা একমাত্র ব্রত হিসেবে ধরে নিয়েছে। ঠিকানা’র এর শেষ প্রান্তে বেশ অনেকটা খোলা জায়গা আছে; সেখানে রাংগামাটির পলওয়েল পার্কের লাভ চত্বরের মত একটি চত্বর বানানো হয়েছে। মানুষজন এখানে কেউ কেউ পরিবার নিয়ে ঘাসের উপর বসে গল্প করছে।
এক নবদম্পতিকে (ধারণা করেছি) দেখা গেল, স্বামী মাথা নীচু করে রেখেছে আর স্ত্রী তার মাথার উকুন বেছে দিচ্ছে কিংবা পাকা চুল! আরেক জায়গায় দেখা গেল, এক মহিলা দোলনায় ছবি তুলতে বসেছে, মহিলার মেয়ে তার বাবাকে বলছে, বাবা, তুমি আম্মার দিকে তাকাও আর মাকে বলছে আম্মা তুমি বাবার দিকে তাকাও। লোকটি চট করে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে; লজ্জা পেয়েছে বোধহয়।
এবার আসি ঠিকানা রেস্টুরেন্টের খাবার নিয়ে
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতেই সবাই যার যার টোকেনের খাবার এনে টেবিল দখল করতে লাগল। মাগরিবের আযানের সময় সবাই আগে পরে ইফতারির মত করে খাবার খেতে শুরু করল; বড় মজার দৃশ্য এটি, পৃথিবীর কোথাও যে এখন যুদ্ধ হচ্ছে কিংবা দেশে দ্রব্যমূল্য বেড়ে গেছে, এসব কিছুই এখানে টের পাওয়া যাবে না। বিপূলসংখ্যক ভলান্টিয়ার নানানভাবে সাহায্য করার জন্য উপস্থিত রয়েছে এখানে। খাবারের খরচ নিয়ে নিচে আলোচনা করেছি। আপনাদের অভিজ্ঞতাও জানতে চাচ্ছি।
যে ব্যাপারগুলো চোখে লাগলো
- সন্ধ্যা হতেই মশার উৎপাত যখন বেড়ে গেলে, ভলান্টিয়াররা তখন ধূপ জ্বালিয়ে মশা তাড়াবার চেষ্টায় রত হলো।
- চাঁদেরও কলংক আছে; যে বড় বিল্ডিংটিতে এত হাজার ফুল গাছ লাগানো, সাইড থেকে দেখা যায়, সে বিল্ডিংটি ময়লা, এমনকি রঙ করাও না, কেবল প্লাস্টার করা।
- এতবড় স্থাপনা, মসজিদ ঘরটির অবস্থা করুণ; চারটি ফ্যান ঘুরছে, ময়লা ফ্লোর, পাতলা কার্পেট, তাও অনেক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। এই নামাজঘরে প্রচুর মুসল্লী নামাজ পড়েন; ভালো মানের কয়েকটি কার্পেট এবং দুটি এসি দিলেই এটি চমৎকার রূপ ধারণ করতে পারে।
ধীরে ধীরে বিদায় নেবার সময় ঘনিয়ে আসল; একটি ফুলের চারা কিনে গেটের দিকে হাঁটা দিলাম।
খরচ
এখানে প্রবেশ করতে আগে লাগত ২০০ টাকা, এখন লাগে ৩০০ টাকা। অফার আছে, যদি আপনি ঢোকার আগে খাবারের টোকেন কিনেন তাহলে এনট্রি ফ্রি; এখানেই আছে শুভংকরের ফাঁকি! একটি বার্গার এখানে সামান্য কিছু ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ও এক গ্লাস জুসসহ ৫২০ টাকা! দুই পিস গ্রিল, দুইটা নান আর দুই গ্লাস জুস ১,৪০০ টাকা; আশা করি বোঝা যাচ্ছে এন্ট্রি কেন ফ্রি!
এখানে দ্বিতীয় বিজনেস হচ্ছে এন্ট্রি ফি; যারা আগেই খাবার কিনবেন না, তাদের উল্লেখিত রেট দিয়ে ঢুকতে হবে। ভিতরে ঢুকে তারা পছন্দসই অনেক খাবার পাবেন, আলাদাভাবে কিনতে পারবেন। তবে সেটার দাম সম্পর্কে একটা আইডিয়া দেই, চটপটি ও ফুচকা এক প্লেট ১৫০ টাকা করে, লাচ্ছি বা কোল্ড কফি ২৭০ টাকা করে।
এদের তৃতীয় ব্যবসা ফুলের চারা; প্লাস্টিকের টবে পিটুনিয়া ফুল বিক্রি করছে ২২৫ টাকায়, ৩৭৫ টাকায় এমনকি ১,৫০০ টাকার পর্যন্ত আছে। যত যাই হোক না কেন, সময় এবং সুযোগ থাকলে এখানে একবার অবশ্যই পরিবার নিয়ে আসা যায়; আমার মতে সেটি বর্ষাকাল হলে ভালো হয়, অবশ্য এটি যে কোন সিজনেই ভালো লাগার মত।
শুধুমাত্র গ্রামীন জমিতে পিটুনিয়া ফুল দিয়ে নানান স্থাপনা তৈরি করে, শহুরে খাবারের আয়োজন করে যে মানুষকে এমন উন্মাতাল করা যায় এবং তা থেকে এত ভালো ব্যবসা করা যায়, তা এই উদ্যোক্তা থেকে শেখার আছে বৈকি।
Good post! We will be linking to this particularly great post on our site. Keep up the great writing