ভোরের এলার্মে ঘুম ভাঙ্গল, ফজরের নামাজের প্রস্ততি নিতে যাব, এমন সময় বারান্দা দিয়ে তাকিয়ে যে দৃশ্য দেখলাম, তার তুলনা মেলা ভার! প্রথম কয়েক সেকেন্ড বিস্ময়ে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। অন্নপূর্ণা সাউথ আর ফিশটেইল যেন মনে হলো আমার কাছে এসে ওদের বাড়িতে যাবার আমন্ত্রণ জানাচ্ছে!
আমি যখন নামাজ পড়ছি, তখন পারভেজ ভাই উঠলেন এবং রুমের পর্দা সরিয়ে তিনি বিস্ময়ে বিহ্বল হয়ে পড়লেন। আমি এরপর বাকিদের ডেকে তুললাম। কেউ কেউ টাইম ল্যাপসে ক্যামেরা বসিয়ে কফির মগে চুমুক দিতে লাগলো।
ভোর থেকে প্রায় দেড়ঘন্টাব্যাপি এই পর্বতমালার ছবি তুললাম ও ভিডিও করলাম। অবাক হয়েছি এটা দেখে যে, চোখের সামনে কিভাবে সময়ের সাথে সাথে অন্নুপূর্ণা সাউথের কালার চেঞ্জ হলো! সে এক অনন্য অনুভূতি। সিরিয়াল ধরে ছবিগুলো দিলাম, দেখলে সহজেই বুঝতে পারবেন।
আজ তেমন তাড়া নেই, তাই সবাই রিল্যাক্স মুডে আছে। আমার এন্টিবায়োটিক খাবার আজ শেষ দিন; ওষুধ কমিয়ে এনেছি, আজ থেকে পেইন কিলার বাদ, গত চারদিনে ৮ টি ট্যাবলেট খেয়েছি। এর মধ্যেই আমাদের সাথের দুই মেয়ে ইয়োগা করল লজের আংগিনায়; এদের মধ্যে কোন জড়তা নেই, ওপেন সিগারেট খায় দেদারসে।
নাস্তা সেরে হেলেদুলে রওনা দিলাম, এবার পথ অনেক চেনা মনে হলো; ফিরে এলাম সেই ঝিনু সাসপেনশন ব্রীজের কাছে। একসময় শেষ বিদায় নিয়ে রওনা হলাম পোখারার পথে। বিকেল চারটা নাগাদ পোখারা পৌঁছে আমার আর পারভেজ ভাইয়ের জন্য টিকেট কাটা হলো আজ রাতের বাসে। বাকিরা পোখারায় আরো দুই একদিন স্টে করবে।
সন্ধ্যা ছয়টার আগে আগে লাঞ্চ শেষ করে পোখারার বিখ্যাত ফেওয়া লেকের ধারে গেলাম; বড় সুন্দর ও মনোহর এই লেকখানি, একে আয়েশ করে দেখতে হয়! ওপাশের পাহাড় নানান রঙ ধারণ করেছে সন্ধ্যার আগমনে; ১৫ মিনিটের বেশী সময় দেয়া গেল না, রওনা হলাম বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে।
ভোরে বাস থেকে নেমে একটা হোটেলে উঠলাম; ফ্লাইট দুপুর ১২ঃ৪০ এ। হাতে কিছু সময় আছে, পকেটে কিছু রুপি আছে, দেখি কাজে লাগানো যায় কিনা; অবশ্য কাল রাতেই পোখারা থেকে কিছু চকলেট আর একটা ক্যাপ কিনে নিয়েছি।
থামেলের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে হটাতই দেখা হয়ে গেল ক্লাস টেনে পড়ুয়া এক মেয়ের সাথে; সে কিছু নেপালি পার্স আর ওয়ালেট বিক্রি করছে রাস্তার পাশে। তার সাথে আলাপ জুড়ে দিলাম; সে জানালো, তার মায়ের অসুখ, এসব বিক্রি করেই তার সংসার চলে। একটা ভিজিটিং কার্ডও বানিয়েছে সে, তাতে নাম লেখা ‘রুবি শর্মা’ আর সাথে তার মায়ের ছবি!
যা রুপি পকেটে ছিল, তা দিয়ে রুবি’র কাছ থেকে ৮ টি জিনিস কিনলাম; সে খুশি হয়ে গেল। রুবি’র কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হোটেলে ফিরিলাম।
দুপুরের ফ্লাইট এয়ার ট্রাফিকের কারনে লেট করাতে ঢাকার বাসায় পৌঁছাতে বিকেল হয়ে গেল; কত স্মৃতি মনে পড়ছে, ক’টার কথাই বা বলব? কিন্তু শেষ বেলায় রুবি শর্মা স্মৃতিতে এমনভাবে দাগা দিয়ে দিবে সে কথা ভাবিনি।
ওকে বলেছিলাম, জানো, আমার ছেলে ক্লাস নাইনে পড়ে; ওকে ক্ষণিকের জন্য আপন করতে চেয়েছিলাম; বার বার মনে হচ্ছিল, ওর মা’র চিকিৎসাটা যদি করিয়ে দিতে পারতাম! বিধাতা যে এমন শান্ত-স্নিগ্ধ ও আয়তলোচনা করে তাকে বানিয়েছেন; তার সে সরলতাই আমার স্মৃতিতে ভাস্মর হয়ে রইল।