আজ ইয়ুমথাং ভ্যালি যাবার দিন; অনেক প্রশংসা শুনেছি এই ভ্যালির, ফলে বাড়তি উত্তেজনা ছিলই। তবে, ভোরে লাচুং এর হোটেল হিডেন ভ্যালির রুম থেকে যে দৃশ্য চোখে ধরা দিল, তার তুলনা মেলা ভার! ঐ দূরে বরফের চাদর মোড়ানো শুভ্র পাহাড়, তার আশে পাশে আরো নানান রঙের ও সাইজের পাহাড় এবং রুমের একেবারে সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক পাহাড় গোটা সকালটাকেই যেন একটি ভালোলাগার আবেশে ভরিয়ে দিল।
ভালো করে চেয়ে দেখলাম, রুমের সামনের বিশালাকার পাহাড়ের মাঝখান থেকে একটি ঝর্ণার ফোয়ারা বেরিয়ে এসেছে; আবারো বিস্মিত হলাম সৃষ্টিকর্তার অপার মহিমা দেখে।
আমি ফজরের নামাজ পড়ে আর ঘুমাইনি; অপেক্ষা করছিলাম কখন গাইড ডাকবে, কিন্তু ডাকছে না। ৭ঃ০০ টায় রওনা দেবার কথা কিন্তু ৭ঃ০০ টা পেরিয়ে গেছে; সহসা মনে হলো, আমরা তো নিষেধ করে দিয়েছি জিরো পয়েন্ট যাব না, বোধকরি সে কারনেই তারা আর গরজ করছে না।
যাই হোক, আমিই ডাকলাম গাইডকে, হোটেলেই নাস্তা সেরে বেরিয়ে পড়লাম ৮ঃ০০ টায়; গাড়ি এগিয়ে চলেছে অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি ইয়ুমথাং ভ্যালির দিকে, ঘন্টা দুয়েক লাগবে যেতে।
যতই সামনে এগোচ্ছি, বরফাবৃত পাহাড় কাছে থেকে আরো কাছে এগিয়ে আসছে, একটা পাহাড় পেরিয়ে আরেকটা পাহাড়ের দিকে এগোচ্ছি আর ক্ষণে ক্ষণে মুগ্ধ ও বিস্মিত হচ্ছি। একসময় ইয়ুমথাং ভ্যালি পোঁছে গেলাম; গাড়ি থেকে নেমে সামনে এগোতেই বিস্ময়ে মুখ হা হয়ে গেল!
হায়! এত সৌন্দর্য একটা ভ্যালি কেমন করে ধরে রেখেছে! এই উপত্যকার চারদিকে চার রকম দৃশ্য, একেক দৃশ্য এমন সুন্দর ও বৈচিত্র্যময় যে মন প্রাণ কেড়ে নেয়। আমি কিছু শর্ট ভিডিও করলাম, কিন্তু কি বললাম ভিডিওতে নিজেই ঠিক বুঝে উঠতে পারলাম না।
প্রাথমিক উত্তেজনার রেশ শেষ হতেই দেখি সা’দ এসে হাজির; বলল, বাবা, চলো নদীর দিকে যাই। নদীর পাড়ে গিয়ে একেবারে মাতোয়ারা হয়ে গেলাম; কি স্বচ্ছ জলরাশি কলকল ধ্বনি তুলে তিরতির করে এগিয়ে চলেছে, বর্ষায় এর রূপ ঠিক কেমন হয় তা দেখবার আশা একবার জাগ্রত হলো।
টেম্পারেচার ৪/৫ ডিগ্রি হবে, পানিতে হাত ডুবাতে তাই সাহস হলো না, তবে কিছুটা পানি পেরিয়ে একটা পাথরের উপর গিয়ে বসলাম আর আনমনে গেয়ে উঠলাম আমাদের কৈশোরে শোনা মাইলসের একটি গান, “পাথুরে নদী চলে, পাহাড়ি মেয়ে নামে; ভেজা তার তনুমন ধরা দেয় না, কি স্বপন এঁকে দিল বোঝা যায় না’!
ধীরে ধীরে এই সৌন্দর্য সয়ে এলো, যথারীতি মনের ঈষাণ কোনে অপ্রাপ্তির রেখা উদিত হলো; সঞ্জু এসে বলল, ভাই, বরফ তো পাইলাম না! কথা সত্য, বরফ পাব ধরে নিয়েই জিরো পয়েন্ট যাবার সিদ্ধান্ত বাতিল করেছিলাম। কিন্তু এতদূর এসে এত কষ্ট করে বরফ যদি না দেখতে পাই, ক্যামনে অন্তর ঠান্ডা হয়!
সঞ্জু বলল, আমি গাইডের সাথে কথা বলে দেখি; আমি হ্যাঁ বলে ভাবতে বসলাম, ১৬,০০০ ফুট উচ্চতায় মাইনাস টেম্পারেচারে আমার এজমার পেশেন্ট ছোট ছেলের কি হবে!
এখানে আসার পথেই কর্পূর কিনে নিয়েছিলাম; যেটার দাম গ্যাংটকে চেয়েছিল ১৫০ রুপি, সেটা কিনেছি ৪০ রুপিতে। কথা ফাইনাল হয়ে গেল; আমরা তড়িঘড়ি করে গিয়ে গাড়িতে উঠলাম, জিরো পয়েন্ট যাব। ছেলে যেহেতু এখন সুস্থ আছে, রিস্ক একটা নেওয়াই যায়; বরফ না দেখে গেলে মান ইজ্জত আর থাকবে না।