ইয়ামথাং থেকে জিরো পয়েন্ট রাস্তাখানি স্মরণে রাখার মত! ইংরেজি ছবিতে আমরা যেমন পাহাড়ের দৃশ্য দেখে থাকি, পুরো রাস্তার দু’পাশ জুড়ে তেমনই সৌন্দর্য হাতছানি দিয়ে ডাকে বারবার। রাস্তার পাশে তাজা বরফের স্তপ পড়ে রয়েছে; তুষার জমে রয়েছে রাস্তার পাশের গাছের পাতাগুলিতে।
গাড়ি থামিয়ে একটা ঝাঁকি দিতে পারলে ঝরঝর করে তুষার পড়ত, যেমন আমরা ভিডিওতে দেখে থাকি। কিন্তু গাড়ি থামানো যাবে না, কারণ আমাদের অলরেডি দেরি হয়ে গেছে; ইতোমধ্যে অন্যরা জিরো পয়েন্ট দেখে গ্যাংটকের দিকে ফিরে যাচ্ছে। বাই দ্যা ওয়ে, ইয়ামথাং ভ্যালি থেকে জিরো পয়েন্ট যেতে অতিরিক্ত ৩,৫০০ রুপি দিয়েছি; পার পারসন ৫০০ করে পড়েছে।
জিরো পয়েন্টের কাছাকাছি এসে পড়েছি; অক্সিজেনের তেমন সমস্যা ফিল করছি না এখনো কেউই। তবে, গাইড বীরেন্দ্রর কাছ থেকে সতর্কতা জারি আছে, এখানে জোরে দৌড়ানো যাবে না। একসময় নামলাম গাড়ি থেকে; তীব্র বেগে স্নো-ফল হচ্ছে! ঘড়ি দেখলাম; ঠিকই আছে, বেলা ১১ঃ০০ টা থেকে স্নো-ফল হবার ফোরকাস্ট ছিল।
জীবনে এই প্রথম স্নো শাওয়ার করে তৃপ্ত হলাম। পরিবারের সবাইকে নিয়ে নেমে গেলাম খোলা ময়দানে, যেখানে পুরো ময়দান জুড়ে রয়েছে পেঁজা তুলোর মত সাদা বরফ! উত্তেজনায় উন্মত্ত হয়ে গেলাম, দৌড়ে গেলাম অনেকদূর; তখনই খানিকটা কষ্ট হতে লাগলো।
ইতোমধ্যে অনেকেই কর্পূর শুঁকতে শুরু করেছে, ভালো কাজও করছে; এর মধ্যেই খবর আসছে, দুই একজন অক্সিজেন শর্টেজের কারনে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। তবে, এই অসুস্থতার হার আসলে একশ’তে একজন বা তারও কম; এখানে কর্পূরই এনাফ।
বরফের উপর তা-ধিন তা-ধিন নাচছি; যাকে নিয়ে ভয় পেয়েছিলাম, সেই সা’দ দিব্যি স্নোতে স্নান করছে। এরপর বরফ খেলায় মেতে উঠলাম, যে যাকে পারল বরফ মারল; তবে, সা’দ আর জয়া’র বরফ মারামারি রীতিমত যুদ্ধে রূপ নিল।
আমি এমনিতেই অনেক জায়গা নিয়ে দৌড়েছি, কিন্তু লোকজন দেখি আরো দূরে যাচ্ছে, একেবারে বরফের পাহাড়ে উঠে যাচ্ছে! যাক বাবা, আমার এত কারেন্ট নেই। আমার স্ত্রী সাধারণত নির্লিপ্ত থাকতে পছন্দ করেন, আমরা যেমন নতুন কিছু দেখলে খুব উচ্ছ্বসিত হই এবং তা প্রকাশ করি, তিনি তেমন করেন না; তবে আজকের এই জিরো পয়েন্টের অভিজ্ঞতা ওনার বেশ ভালো লেগেছে।
ধীরে ধীরে রাস্তায় উঠে এলাম; কিছু খাওয়া দরকার। এখানে দেদারসে বিক্রি হচ্ছে কফি, চানাবুট, মমো এবং ম্যাগী নুডুলস! প্রথমে এক দোকানে গেলাম, পিচ্চি এক কাপ কফি নিল ৫০ রুপি করে; ভাবলাম এই ১৬,০০০ ফুট উপরে যে তুষারে ভিজে ভিজে কফি বানিয়ে খাওয়াচ্ছে, তাই বেশী!
কিন্তু না, জয়া-ফাতেমারা যেখানে বসেছে সেখানে গিয়ে দেখি সেইম কফি ৩০ রুপিতে সেল হচ্ছে। আমরা সবাই মিলে বেশ খাবার-দাবার খেয়ে উষ্ণ হয়ে গেলাম। এর পরপরই জিরো পয়েন্ট সাইনবোর্ডের কাছে ছবি তুলতে গেলাম।
ফিরতে হয়, তাই ফিরে চললাম; সাথে রয়ে গেল একরাশ মুগ্ধতা ও বিস্ময়! জীবনে প্রথম বরফের পাহাড়ে হাঁটা, জীবনে প্রথম স্নো-ফলে শাওয়ার নেয়া, ১৬,০০০ ফুট উপরে অক্সিজেন ছাড়া দিব্যি চলতে পারা; এ সবই স্মৃতির পাতায় যোগ হয়ে রইল। সবচেয়ে বড় লাভ হয়েছে, আমার স্ত্রীর সাহস বেড়ে গেছে; তিনি এখন কাশ্মীর যাবার ব্যাপারে ব্যপক সাহস পেয়েছেন।
রোশান দা’র গাড়ি এগিয়ে চলেছে। ফাতেমা’র জোর চাওয়া ছিল, ইয়ামথাং এর ফুলের কাছে এলে গাড়ি দাঁড় করাতে হবে, সে ছবি তুলবে; হলোও তাই। আমিও নেমে পড়লাম এবং এই ট্যুরের সুন্দর ভিডিওগুলির একটি করার সুযোগ পেলাম।
লাচুং ফিরে হোটেল হিডেন ভ্যালিতেই লাঞ্চ করলাম। তারপর গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম। একদিনের জার্নি হিসেবে কষ্ট হয়ে গেল; মোট ১৩ ঘণ্টা বাইরে ছিলাম, এর মধ্যে ১০ ঘণ্টা গাড়ি চলেছে, বিষয়টা কষ্টের বটে! গ্যাংটকের হোটেলে ফিরতে রাত ৯ঃ০০ টা বেজে গেল; তবু দুঃখ নেই, আজ প্রকৃতি যেভাবে দু’হাত ভরে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে, তার তুলনায় এই জার্নির কষ্ট একেবারেই নস্যি!