![শান্ত শহর মাদিনা - (হজ্জের দিনগুলি-১০ | শেষ পর্ব) 1 Madina](https://shaheenstravelstory.com/wp-content/uploads/2023/09/Screenshot-2023-09-04-195248.jpg)
মক্কা থেকে মদিনায় যাওয়ার রাস্তাটা অদ্ভুত; মরু প্রান্তরের উপর দিয়ে সোজা একটা রাস্তা চলে গেছে, এত সোজা যে, গাড়ি স্টার্ট দিয়ে স্টিয়ারিং ধরে বসে থাকলেই হয়। আনুমানিক ৫০ হাত বাম দিয়ে আরেকটা রাস্তা মদিনা থেকে মক্কায় চলে গেছে। এই পুরো ৪৫০ কিমি রাস্তার দুপাশে কেবল বালু আর অগনিত পাহাড়, এ ছাড়া আর কোন দৃশ্য নেই।
কোন মানুষজন চোখে পড়েনি, কেবল ঐ দূরে চার/পাঁচটি ঊট একবার দেখেছিলাম। গাড়ির গতি ঘন্টায় ১৩০/১৪০ কিমি, ; গোটা পথ যেতে মাত্র ঘন্টা পাঁচেক সময় লাগে। মাঝখানে খাবার ও নামাজের বিরতি আছে। তবে সময় নষ্ট হয় মদিনায় ঢোকার আগে যে চেক পয়েন্ট আছে, সেখানে। আমি কাফেলা থেকে দলছুট হয়ে নানান হ্যাপা পেরিয়ে সোনার মদিনায় প্রবেশ করলাম।
অত্যন্ত শান্ত শহর মাদিনা, এখানে মক্কার ব্যস্ততা নেই, কোন হই-হুল্লোড় নেই, হকারের হাঁকডাক নেই; যেমন কবি গ্রামের কথা বলেছিলেন, ‘এখানে এসে থেমে গেছে ব্যস্ত ঘড়ির কাঁটা’। সন্ধ্যা নাগাদ হোটেলরুমে প্রবেশ করলাম। তিনদিন থাকব সাব্যস্ত হয়েছে; আমার আর আম্মার একই রুমে থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। আম্মা ঘুমিয়ে গেলে আমি ক্লান্ত শরীর নিয়েই মসজিদে নববীতে গেলাম, সময় তখন রাত বারোটা। অন্য এক কাফেলার প্রধান তাঁর দলের লোকদের বুঝাচ্ছিলেন, আমি কান পাতলাম।
ইসলামের চার খলিফার বাড়ির জায়গায় যে চারটি মসজিদ নির্মিত হয়েছে তিনি তা বলছিলেন আর সেগুলোর অবস্থান দেখাচ্ছিলেন। মসজিদে নববীর পশ্চিম থেকে এগোলে রাস্তার বামে পড়বে হযরত ওমর মসজিদ আর ডানে হযরত ওসমান মসজিদ। আরেকেটু সামনে এগোলে পড়বে মসজিদে গামামা, যেখানে বৃষ্টির জন্য প্রিয়নবী (সাঃ) দোয়া করেছিলেন। সেটার একটু সামনে বামেই রয়েছে হযরত আবুবকর মসজিদ আর তারও খানিকটা দূরে রয়েছে হযরত আলী মসজিদ। এই দুই মসজিদের ডানেই রয়েছে মসজিদে নববী।
ছয় নাম্বার গেট দিয়ে মসজিদ প্রাঙ্গণে প্রবেশ করলাম। অনিন্দ্য সুন্দর এই মসজিদ কমপ্লেক্সটি, নয়নজুড়ানো সবুজ গম্বুজটি সহজেই চোখে পড়ে, বিখ্যাত ছাতাগুলি গুটানো রয়েছে, জায়গায় জায়গায় দেখা যাচ্ছে জমজমের কল, মক্কার মত অনেক পানি ছিটানো পাখাও রয়েছে কমপ্লেক্সজুড়ে। আমি দুই নাম্বার গেট দিয়ে প্রবেশ করে দুই রাকাত নামাজ পড়লাম। সেখান থেকে বের হয়ে এক নাম্বার গেট দিয়ে প্রবেশ করলাম। শেষ মাথায় গিয়ে পেলাম আকাঙ্খিত সেই স্থান যেখানে আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) শায়িত আছেন তাঁর দুজন ঘনিষ্ট সাহাবীকে পাশে নিয়ে।
এক বাংলাদেশী ভাই, যিনি সেখানে কাজ করেন, এসে জিগ্যেস করলেন আমি বাংলাদেশী কিনা। হ্যাঁ বলতেই তিনি দেখিয়ে দিয়ে বললেন, বাম পাশের যে তিনটি সোনালী চাকতি দেখা যাচ্ছে, সেখানে কিছু নেই, ডানপাশেও যে তিনটি সোনালী চাকতি দেখা যাচ্ছে সেখানেও কিছু নেই; কেবল মাঝখানের তিনটি সোনালী চাকতিই নির্দেশ করছে নবী (সাঃ) এবং তাঁর সাহাবীদের কবর, প্রথমটি একটু বড় এবং সেটি প্রিয়নবী (সাঃ) এর, তার পরেরটি হযরত আবুবকর (রাঃ) এর এবং তার পরেরটি হযরত ওমরা (রাঃ) এর। আমি একে একে তাঁদের প্রত্যেককে সালাম জানিয়ে ব্যথিত হৃদয়ে বের হলাম!
পরদিন সকালে আম্মাকে মসজিদে ঢুকিয়ে দিয়ে সারা মসজিদ কমপ্লেক্সটি ঘুরে দেখলাম, আয়তনে এটি এখন বিরাট; পুরোটা একবার ঘুরে আসতে কষ্ট হয় বৈকি। প্রায় চল্লিশটির মত দরজা আছে মসজিদে নববীতে। নবীর সময়ে মসজিদে নববীর যে অংশটুকু ছিল, সেটুকুর উপরের দিকের গম্বুজে সবুজ রঙ দেয়া আছে (শোনা কথা)।
হযরত বেলাল (রাঃ) যেখান থেকে আজান দিতেন সেটাও একজন দেখালেন, প্রথম মিম্বর হওয়ার আগে যে খেজুর গাছে হেলান দিয়ে প্রিয়নবী (সাঃ) খুতবা দিতেন সে গাছটি কোথায় ছিল তাও তিনি দেখালেন। মসজিদে নববীর রিয়াজুল জান্নায় নামাজ পড়তে লাইন ধরতে হয়। আমি মদিনা ছাড়ার আগের রাত পৌনে একটায় লাইনে দাঁড়িয়ে দেড় ঘন্টা পর সিরিয়াল পেয়েছি। রিয়াজুল জান্নাহ দিয়ে আগালে নবীজির (সাঃ) রওজার সেই সোনালী চাকতি আরো কাছ থেকে দেখা যায়।
একদিন সকালে মসজিদে নববীতে ঢুকেছি, দেখি অত্যন্ত সুন্দর করে সাজানো এই মসজিদটি। বিভিন্ন বাদশাহরা এটি কলেবরে অনেকখানি বাড়িয়েছেন, ভিতরে মোটা লাল রঙের কার্পেট। জায়গায় জায়গায় ১৫/২০ জন করে ছাত্র গোল হয়ে কার্পেটে বসেছে আর শিক্ষক চেয়ারে বসে লেকচার দিচ্ছেন, ছাত্ররা মন দিয়ে শুনছে; বড় সুন্দর দৃশ্য। পর্দার ঐ পাশে মহিলাদের শোরগোল শোনা যাচ্ছে, তাঁরা রিয়াজুল জান্নায় নামাজ পড়ার জন্য লাইন ধরেছেন; এখানে মহিলাদের জন্য টাইম ফজরের পর থেকে জোহর পর্যন্ত।
তৃতীয়দিন সকালে আল-বাকি কবরস্থানে গেলাম, যেখানে শায়িত আছেন দশ হাজারেরও বেশী সাহাবী। কবরস্থানটি আয়তনে বেশ বড়। যে কোন কবরস্থানে মহিলাদের প্রবেশ নিষেধ, ফলে তাঁরা বাইরে থেকেই দোয়া দুরুদ পড়েন। এরপর মসজিদ কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে মাইক্রোতে সিটি ট্যুরে বের হলাম; একজন দশ রিয়াল করে।
প্রথমেই গেলাম ওহুদ পাহাড়ের পাদদেশে, যেখানে আমাদের প্রিয়নবী (সাঃ) মারাত্মকভাবে আহত হয়েছিলেন; সেখানে শহীদ হওয়া ৭০ জন সাহাবীর জন্য একটি কবরস্থানও আছে। সেখান থেকে খন্দক পার হয়ে গেলাম মসজিদে কিবলাতাইনে, যেখানে নামাজরত অবস্থায় নবী (সাঃ) মসজিদে আকসা থেকে মুখ ঘুরিয়ে কাবা’র দিকে ফিরে নামাজ শেষ করেছিলেন। আর সবশেষে গেলাম মসজিদে কুবা’য়। প্রত্যেক শনিবারে নবী (সাঃ) এখানে এসে দুই রাকাত নামাজ পড়তেন, এটি হচ্ছে মদিনার প্রথম মসজিদ।
তিনদিনের বাকি সময়টুকু কেনাকাটায় গেছে, রেস্ট নেয়ার টাইম ছিলনা। ফেরার আগের দিন বিকেলে আমরা বেলাল মসজিদ রোডে একটি ঝর্ণার পাশে বসেছিলাম; অনিন্দ্যসুন্দর এই ঝর্ণার পানির নাচন, আরবী বাচ্চারা সেখানে ভিজছে আর খেলছে। মসজিদে নববীর চারিপাশের দোকানগুলোতে দাম তুলনামূলক বেশী। মসজিদ থেকে পশ্চিম দিকে গেলে বেলাল মসজিদ সংলগ্ন মার্কেটে দাম কিছুটা কম আর পূর্ব দিকে পৌনে এক কিমি গেলে রাস্তা পেরিয়ে বাংলাদেশীদের মার্কেট পাওয়া যায়; সেখানে সব জিনিসপত্র পাওয়া যায়, দাম তুলনামূলক কম, তবে দামাদামি করতে হয়। বাংলাদেশের মানুষদের ৮০% কেনাকাটা এখান থেকেই হয়।
খেজুর মোটামুটি সস্তা এখানে, আরও কমদামে পেতে হলে খেজুরের পাইকারি মার্কেটে যেতে হবে; যেতে ভাড়া লাগবে ৪০ রিয়াল। এছাড়া কাজু বাদাম, আখরোট ও চকলেট অনেক সস্তা মনে হয়েছে। কম্বলেরও পাইকারি মার্কেট আছে এখানে। রয়েছে অনেক আতরের দোকান। অত্যন্ত ধুরন্ধর প্রকৃতির কিছু ফকির ঘুরে বেড়ায় এখানে। তবে শুক্রবারে দেখেছি কিছু অসহায় নিগ্রো বুড়ো মহিলা রাস্তার মোড়ে মোড়ে ভিক্ষার আশায় বসে আছেন। ফেরার দিন খুব অসহায়ের মত লাগেজ বাঁধার জন্য কাউকে খুঁজছিলাম। চট্রগ্রামের এক ভাই যিনি এখানে হোটেলে কাজ করেন, তিনি টাকার বিনিময়ে যত্নসহকারে লাগেজগুলো বেঁধে দিয়েছেন।
কাফেলা ছেড়ে একা একা যারা বের হয় তাদেরকে বলে ‘ফুরাদা’। ফুরাদা হয়ে নানান যন্ত্রণা সয়ে ক্লান্ত শরীরে যখন সৌদিয়া এয়ারলাইন্সের প্লেনের দরজায় পা রাখলাম, বিমানবালা বললেন, ইউ গো টু লেফট সাইড। ককপিটেই বসায় কিনা ভাবতে ভাবতে এগোলাম, অত্যন্ত সুন্দর বিজনেস ক্লাস এরিয়া, একেবারে প্রথম সিটে নিয়ে আমাকে আর আম্মাকে তারা বসিয়ে দিলেন; অনেক খরার পর একটু যেন বৃষ্টি এলো।
গোটা সফরে আমার মা’কে বিশেষভাবে দেখেছি মোট দুইদিন! একদিন, রাতে মুজদালিফার মাঠে রাস্তার আইল্যান্ডে যখন আরো দুইজন মহিলার সাথে ঘুমিয়েছিলেন, আমি দূর থেকে বার বার উঁকি দিয়ে দেখছিলাম তাঁর কোন অসুবিধা হয় কিনা; আর আজ ফেরার পথে ক্লান্ত শরীরে যখন বিজনেস ক্লাসের সিটে বসে অঘোরে ঘুমাচ্ছেন, তখন! পিতা-মাতা যখন ঘুমন্ত সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে থাকে, তখন যেমন মায়া লাগে; একইরকম মায়া লাগে সন্তানও যখন ঘুমন্ত পিতামাতার মুখের দিকে চেয়ে থাকে! আজ নতুন করে এই জিনিস উপলব্ধি করে বড় ভালো লাগল, এই ভালোলাগার রেশটুকু থাকতে থাকতেই তাকিয়ে দেখলাম, সৌদিয়ার প্লেন মেঘের ভেলার পাশ কেটে ভাসতে ভাসতে এগিয়ে চলল।
(২০১৮ সালের লেখা; একেবারেই ব্যক্তিগত অনুভূতি, কাউকে আঘাত উদ্দেশ্য নয়। এবার বা ভবিষ্যতে যারা হজ্জ করবেন, তাদের উপকারে আসতে পারে ভেবে পুনঃপ্রকাশ। আল্লাহ আমাকে সকল প্রকার রিয়া থেকে মুক্ত রাখুন; আমীন।) |