মক্কায় শেষদিন – (হজ্জের দিনগুলি-৯)

মক্কায় শেষদিন - (হজ্জের দিনগুলি-৯)

মক্কা ছাড়ার এক দিন আগে ট্রাভেল এজেন্ট থেকে বাস ভাড়া করে সিটি ট্যুরের ব্যবস্থা করা হয়েছে, সেই বাসে চেপে আমরা উৎসাহ সহকারে রওনা হলাম। সুন্দর সুন্দর রাস্তা, টানেল আর ফ্লাইওভার দিয়ে সাজানো সৌদি আরবের সড়কপথ। শুরুতেই চোখে পড়ল সুদৃশ্য আল রাজি মসজিদ আর এরপর দেখলাম বিখ্যাত উম্মুল কুরা ইউনিভার্সিটি; মরুময় জায়গায় খাপছাড়াভাবে স্থাপিত হয়েছে এর একেকটি অনুষদ, এক অনুষদ থেকে আরেক অনুষদে গাড়ি ছাড়া চলতে পারার কথা নয়, নেই কোন প্রাকৃতিক সৌন্দর্য!

অজস্র পাহাড়ের সমন্বয় এই মক্কা নগরী, পাহাড়ের গা বেয়ে উঠে গেছে সুদৃশ্য সব বাড়ি। অধিকাংশ বাড়ি বিস্কিট কালারের; এর একটা ব্যাখা হতে পারে, এত বেশী তাপমাত্রায় অন্য রঙ টেকসই হয় না, তাই এই ব্যবস্থা! কিছুদূর যাওয়ার পর গাড়ি থেকে নেমে দেখলাম জাবালে সুর, এই পর্বতের গুহায় প্রিয়নবী (সাঃ) ও হযরত আবু বকর (রাঃ) হিজরতের সময় লুকিয়ে ছিলেন। এটি উচ্চতায় জাবালে নূরের সমান বা কিছুটা বেশী।

এরপর আমরা গেলাম জাবালে রহমতে, যেটি রয়েছে আরাফায়। কথিত আছে, এই পাহাড়েই মিলন ঘটেছিল আদি পিতা হযরত আদম (আঃ) ও মা হাওয়া (আঃ) এর আর এই পাহাড়ের নীচে দাঁড়িয়েই বিদায় হজ্জের ভাষণ দিয়েছিলেন প্রিয়নবী (সাঃ)। এই পাহাড়ের উপর একট পিলার আছে, মানুষ সেটাকেই পূজা করছে, অথচ সেখানে স্পষ্ট করে লিখা আছে যে কোন ধরনের আচার সেখানে নিষিদ্ধ ও সেটি বিদাত; কেউ কেউ দেখলাম নামাজও পড়ছে।

আরাফায় আছে মসজিদে নামিরা, চলতি পথেই দেখতে হলো কারণ এখানে গাড়ি থামানো যায় না। এই মসজিদ বছরে একদিন; কেবল হজ্জের দিনই খোলা হয়। জাবালে রহমত থেকে মুজদালিফার দিকে যেতে নজরে পড়ল ‘নহরে জোবাইদা’। বাদশা হারুন-অর-রশিদের স্ত্রী জোবাইদা হাজী সাহেবদের তৃষ্ণা মেটানোর জন্য আরব সাগর থেকে একটি নহরের ব্যবস্থা করেন, এটিই নহরে জোবাইদা। এর অবশেষ হিসেবে একটি লম্বা দেয়াল দেখা যায়।

মুজদালিফা থেকে মিনায় যাওয়ার পথে যেখানে বাদশাহ আবরাহা ধ্বংস হয়েছিল সেই জায়গাটা পার হয়েই বামে উপরে তাকালে চোখে পড়ে একটি ক্রিম কালারের ছোট পিলার। এটাই সেই জায়গা যেখানে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) হযরত ঈসমাইল (আঃ) কে কোরবানি করতে উদ্যত হয়েছিলেন। এই যে হজ্জ, এটা আসলে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও তার পরিবারের নানান ঘটনাবলীরই অনুকরন ও অনুসরন; হযরত ঈসমাইল (আঃ) এর কোরবানির কারনে আমরা কোরবানি করি, হযরত ইবরাহিম (আঃ) কাবা পূনর্নিমাণ করেছেন বলে আমরা কাবা তাওয়াফ করি, মা হাজেরা সাফা-মারওয়া দৌড়েছেন বলে আমরাও তাই করি। এরপরেও যখন অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত হয় না, তখন অপরাধীর মত মাথা ন্যাড়া করে হলেও অপরাধের বোঝা কমানোর চেষ্টা করি!

মিনায় রয়েছে বিখ্যাত মসজিদে খায়েফ। ফেরার পথে দেখলাম তাঁবুগুলো ফাঁকা। বিছানাগুলো সরিয়ে নেয়া হয়েছে; তাঁবুর স্টিলের ফ্রেমগুলো শুধু রয়ে গেছে, আবার এক বছর পর ব্যস্ত হবে এই এলাকা; আমাদের মত একইরকম অনুভূতি আর স্মৃতি নিয়ে ফিরবে মানুষ। সেখান থেকে আল-মুয়াল্লা (যেখানে মা খাদিজার কবর রয়েছে) হয়ে, জ্বিন মসজিদ হয়ে আয়েশা মসজিদে গেলাম; অত্যন্ত সুদৃশ্য এই মসজিদ। আয়েশা মসজিদ থেকে হোটেলে ফিরে যাওয়ার পথেই ইন্টারনেটে পড়লাম, বলিউড হিরো অক্ষয় কুমার টুইট করেছেন, তার একটা ছবি সৌদি আরবে মুক্তি পেতে যাচ্ছে প্রথমবারের মত, অন্তত ৩০ টি সিনেমা হলে সেটি মুক্তি পাবে! তিনি নাকি বিষয়টা নিয়ে খুব উত্তেজিত!

মক্কার শেষদিন সকালে আম্মাকে নিয়ে কাবা’য় গেলাম। সেখানে তাওয়াফ শেষ করে বাদশাহ ফাহাদ গেটে আম্মাকে বসিয়ে রেখে একবার হাজরে আসওয়াদকে চুমু খাওয়া যায় কিনা সেই চেষ্টা করতে গেলাম। সেখানকার ঠেলাঠেলি অনুভব করতে হলে সশরীরে যেতে হবে, সবার একটাই চেষ্টা, কেমন করে সেই কালো পাথরটিকে চুমু খাওয়া যায়। আমি খুব বেশী ঠেলাঠেলি না করেও পাথরের কাছে পৌঁছে গেলাম, বার তিনেক সেটাকে হাতে স্পর্শ করে সেই হাতে চুমুও খেলাম, কিন্তু যেই না পাথরের কাছে ঠোঁট নিতে গিয়েছি অমনি উল্টোদিক থেকে যেন মানুষের বিরাট এক ঢেউ এলো, আমি সেই ঢেউয়ে তিনহাত দূরে সরে গেলাম, আর ওমুখো হলাম না। মহিলাদের অবস্থা হয় সেখানে একেবারে যা তা, চিড়ে চ্যাপ্টা হয়ে যাওয়ার মত, তবু তাদের দমানো যায় না। সেখানে কোন মায়া নেই, স্যাক্রিফাইস নেই; জান্নাত তো এত ছোট নয়, যতটা ঠেলাঠেলি লোকেরা হাজরে আসওয়াদ ছুঁয়ে জান্নাতে যাওয়ার চেষ্টা করে!

পরদিন সকালে মদিনা যাবার গাড়ি; রাত্রিবেলা গিয়ে আমি আর আম্মা বিদায়ী তাওয়াফ করে এলাম। অনেক স্মৃতি নিয়ে কাল মক্কা ছাড়ব। বিশেষভাবে ভালো লেগেছে আমার ফার্মেসির বন্ধু নেওয়াজের সাথে কাটানো সন্ধ্যাটুকু; ও অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছিল, হটাতই একদিন মাগরিবের পর দেখা হয়ে গিয়েছিল আব্দুল আজিজ চত্তরে, আমরা একসাথে এশা পর্যন্ত ছিলাম। ঈসমাইল গেটে খুঁজে পেয়েছিলাম আমাদের মসজিদের খতীব সাহেবকে, যাকে আমি মনে মনে খুঁজছিলাম। আমার রুমমেটদের সাথে রয়েছে অনেক আনন্দের স্মৃতি, তাঁরা প্রত্যেকেই ভালো মানুষ; মনে পড়ছে ৭২ বছরের বৃদ্ধ আংকেলের কথা, যিনি নিজে একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং রেডিও-টিভির গীতিকার, মাঝেমাঝেই যিনি নিজের লেখা গানের সুর ধরতেন ভাঙ্গা কন্ঠে!

(২০১৮ সালের লেখা; একেবারেই ব্যক্তিগত অনুভূতি, কাউকে আঘাত উদ্দেশ্য নয়। এবার বা ভবিষ্যতে যারা হজ্জ করবেন, তাদের উপকারে আসতে পারে ভেবে পুনঃপ্রকাশ। আল্লাহ আমাকে সকল প্রকার রিয়া থেকে মুক্ত রাখুন; আমীন।)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top