উকুফে মুজদালিফা – (হজ্জের দিনগুলি-৮)

উকুফে মুজদালিফা - (হজ্জের দিনগুলি-৮)

হজ্জের দিন সন্ধ্যার পর আরাফার ময়দান ছেড়ে মুজদালিফার উদ্দেশ্যে রওনা হলাম; সেখানে গিয়ে দেখি, একি! রাস্তা বোঝাই মানুষ শুয়ে-বসে রয়েছে। এমন অনেক ফ্যামিলি দেখলাম, যারা চেহারাতেই অনেক অভিজাত কিন্তু বসে রয়েছে রাস্তায় ম্যাট্রেস পেতে। আমি তাদের জন্য করুণা অনুভব করলাম; আমি তখনো জানিনা আমার জন্য সামনে কি অপেক্ষা করছে! ২০০ গজ হাঁটার পর যখন কাফেলার একজন বললেন, এইখানে বিছানাচাদর পাতেন, আমার মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল! এই পিচঢালা রাস্তার উপর বিছানা পাততে হবে? মানে কি? তিনি বললেন, এটাই উকুফে মুজদালিফা!

বেশী বিস্মিত হবার সুযোগ তিনি দিলেন না, বিছানাচাদর রাস্তার পাশে পেতে দিলাম। আম্মাসহ তিনজন মহিলাকে শোয়ার ব্যবস্থা করে দিলাম আইল্যান্ডের উপর। সেখানে মাটি থাকায় জায়গাটা ঠান্ডা হয়েই ছিল, শোয়ার সাথে সাথে আম্মা ঘুমিয়ে পড়লেন। সৌদি আরবের রাস্তা কখনো ঠান্ডা হয় না, এই গরম পিচের উপর বিছানাচাদর পেতে ঘুমানো অসম্ভব। এর মধ্যেই একটা আরবী ফ্যামিলি আমাদেরকে তিনটি ম্যাট্রেস দিয়ে নিজেরা চলে গেলেন। আমার ভাগেরটি আমি দিয়ে দিলাম এক বৃদ্ধাকে, নিজে জেগে রইলাম সারারাত। ভোরের দিকে পাথর কুড়িয়ে নিয়ে এসে ফজর পড়ে নিলাম।

কাফেলায় কিছু অসুস্থ বুড়ো মানুষ থাকার কারনে সূর্য উঠার আগেই মুজদালিফা ত্যাগ করতে পারলাম না। একটু দেরিতে রওনা দিয়ে ২০০ গজ গিয়ে ট্যাক্সি পেলাম। ভাড়া ১০ গুন বেশী। সৌদিতে হজ্জের তিনদিন ট্যাক্সিভাড়া ১০ গুন বেশী থাকে, অনেক সৌদিয়ান এই কয়দিন নিজেদের গাড়ি নিয়ে টাকার আশায় রাস্তায় নেমে পড়ে। যাই হোক, জামারার এক কিলোমিটার দূরে ট্যাক্সি নামিয়ে দিল। সেখান থেকে হেঁটে জামারায় পাথর মেরে হেঁটেই মক্কার হোটেলে ফিরলাম।

মাগরিরের পর ফরজ তাওয়াফ আর সাঈ করতে গেলাম। রাত এগারোটায় ফিরলাম। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েই রেখেছিলাম যে, রাতের একটা অংশ মিনাতে কাটাব। সালাফি মতে এই রাতসহ আরো একরাত মিনাতে কাটানো ওয়াজিব (ছুটে গেলে দম/কোরবানি দিতে হবে) আর হানাফি মতে সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। অধিকাংশ বাংলাদেশী মক্কার হোটেলগুলোয় শুয়ে থাকে আর এখান থেকে গিয়ে গিয়ে জামারায় পাথর মেরে আসে; এটা একেবারেই ঠিক নয়।

আমরা রাত আড়াইটায় রওনা দিয়ে রাত চারটার দিকে মিনার তাঁবুতে পৌঁছলাম। এরপর ফজর পড়ে ঘুমিয়ে নিলাম। দুপুরের পর সুড়ঙ্গপথে হেঁটে আবার পাথর মারতে গেলাম এবং ফিরে এলাম। পরদিন (১২ ই জিলহজ্জ) দুপুরের পর প্রস্ততি নিয়ে বের হলাম এবং জামারায় পাথর মেরে একেবারে মক্কায় চলে এলাম। হজ্জের আনুষ্ঠানিকতা এখানেই সমাপ্ত হলো।

এই এক সফরে কতকিছু দেখলাম; কত মানুষ হারালো, কতজন অজ্ঞান হলো, কতজন কত জায়গায় কাঁদলো! কেউ হারিয়ে গেলে একটা সুবিধা হচ্ছে, তাকে হজ্জ মিশনে পাওয়া যাবেই, আর একবার হজ্জ মিশনে গেলে তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করা যাবেই। জামারায় পাথর মারার ব্যাপারে মানুষের যে উৎসাহ, এমন উৎসাহ আর কিছুতেই চোখে পড়ে না। সাতটি পাথর মারার কথা, এক মহিলা দেখলাম, নিজের সাতটি মারা শেষ হলে তিনি সামনে পড়ে থাকা পাথর এক মুঠে নিয়ে আবার ছুঁড়ে মারলেন, পরে একেবারে কাঁচিয়ে নিয়ে আবার মারলেন; এমন তৃপ্তির বিষয় জীবনে খুব কম আসে!

সৌদি পুলিশদের একটা প্রশংসা না করলেই নয়, যে দক্ষতার সঙ্গে তারা ৩০ লক্ষ লোককে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে তার তুলনা নেই। কাবা’তে তারা যেভাবে মানুষের স্রোত নিয়ন্ত্রণ করে, এটা সঠিকভাবে করতে না পারলে মৃতের সংখ্যা হতো অগনিত। কিন্তু একটা বড় দূর্বলতা তাদের রয়েছ।, একটা ইংরেজি শব্দও তারা বোঝে না! অনেক প্রয়োজনীয় বিষয় তাদের কাছ থেকে চাইলেও জানা যায় না, রাস্তা হারিয়ে ফেললেও কোন কিনারা করা যায় না।

আরেকটি বিষয় হলো, ঈদের দিন থেকে শুরু করে পরের দুইদিন শহরে ব্যাপক বাস সার্ভিস দিলে মানুষের কষ্ট অনেক কম হতো। সবচেয়ে বেশী যেটার প্রয়োজন অনুভব করেছি সেটা হলো সাইনবোর্ড; তাঁবুগুলোর নাম্বার অনুসারে যদি জায়গায় জায়গায় সাইনবোর্ড থাকত, তাহলে মানুষের কষ্ট আরো কমে যেত। শুধুমাত্র রাস্তা না চেনার কারনে আমাকে অনেক বেশী হাঁটতে হয়েছে।

হজ্জ শেষ হওয়ার ইমিডিয়েট পরপর-ই আমার কাফেলা থেকে দলছুট হয়ে মদিনায় যাওয়ার কথা, এজেন্ট সেই ব্যবস্থা করতে পারছেনা। তারা মদিনায় যাওয়ার পারমিশন যোগাড় করতে পারছেনা। আমরা কাবা’য় যাওয়া-আসা করছি, ভিড় বেড়ে গেছে মারাত্মক, অনেকেই বিদায়ী তাওয়াফ করছে। এর মধ্যেই একদিন দেখলাম রহমতের বৃষটি হয়ে গেছে, ছাতা নিয়ে রাস্তায় বেরিয়েই দেখলাম, গাড়ির হেডলাইটের আলোয় পিচঢালা রাস্তা চিকচিক করছে; অনেকদিন পর মনে হলো ঢাকার রাজপথের একটি দৃশ্য দেখলাম।

একটি গোপন কথা বলি, এই সফরের অনেক বড় একটি পাওয়া হলো মায়ের হাত ধরে হাঁটতে পারা! আমার আম্মা যেহেতু তাড়াতাড়ি কিংবা অনেকক্ষণ হাঁটতে পারেন না সেহেতু তাঁর হাঁটার জন্য ভর প্রয়োজন; এই পুরো বত্রিশটি দিন তিনি আমার বাহু ধরে হেঁটেছেন কিংবা কখনো কখনো আমি তাঁর হাতের আঙ্গুলগুলো ধরে হেঁটেছি। শেষ কবে মায়ের আঙ্গুল ধরেছিলাম মনে পড়ে না, আবার কবে ধরব তাও জানিনা। কিন্তু এই পবিত্র হজ্জ এমন একটি সুযোগ এই মাঝবয়সে করে দিয়েছে যার অনুভূতি বাকি জীবন আমার সঙ্গী হয়ে রইবে; এই তৃপ্তির কোন সীমা-পরিসীমা নেই; মহান আল্লাহ্‌র দরবারে অশেষ কৃতজ্ঞতা।

(২০১৮ সালের লেখা; একেবারেই ব্যক্তিগত অনুভূতি, কাউকে আঘাত উদ্দেশ্য নয়। এবার বা ভবিষ্যতে যারা হজ্জ করবেন, তাদের উপকারে আসতে পারে ভেবে পুনঃপ্রকাশ। আল্লাহ আমাকে সকল প্রকার রিয়া থেকে মুক্ত রাখুন; আমীন।)

5 thoughts on “উকুফে মুজদালিফা – (হজ্জের দিনগুলি-৮)”

  1. I’m not sure where you’re getting your info, but good topic.
    I needs to spend some time learning much more or understanding more.
    Thanks for magnificent info I was looking for
    this info for my mission.

    Feel free to surf to my blog: nordvpn coupons inspiresensation (da.gd)

  2. 350fairfax nordvpn coupons inspiresensation
    Hey there I am so grateful I found your weblog,
    I really found you by mistake, while I was looking on Bing
    for something else, Regardless I am here now and would
    just like to say kudos for a incredible post and a all round thrilling blog (I also love the
    theme/design), I don’t have time to read through it
    all at the minute but I have book-marked it and also included
    your RSS feeds, so when I have time I will be back to read much more,
    Please do keep up the excellent work.

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top