আরাফায় অবস্থান – (হজ্জের দিনগুলি-৭)

আরাফায় অবস্থান - (হজ্জের দিনগুলি-৭)

দেখতে দেখতে হজ্জের দিনগুলি কাছে চলে এলো। ৭ই জিলহজ্জ রাত ১১ টায় রওনা দিয়ে রাত ১২:১৫ তে (৮ই জিলহজ্জ) মিনার তাঁবুতে পৌঁছলাম। গিয়ে দেখি এক অপরূপ দৃশ্য, পাহাড়ের গায়ে ও পাদদেশে হাজার হাজার তাঁবু আর রাতের বেলা সেগুলোতে আলো জ্বলজ্বল করছে; সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য! আরো অবাক হলাম নিজের তাঁবুতে গিয়ে, সারিবদ্ধভাবে ফোমের বিছানা একটার সাথে একটা লাগানো রয়েছে, প্রতিটি বিছানার প্রশস্ততা ২০ ইঞ্চি! সাথে রয়েছে একটি বালিশ ও একটি চাদর। আপনি যতই মোটা হোন না কেন, ২০ ইঞ্চির মধ্যেই নিজেকে আঁটাতে হবে, হয় চিত হয়ে না হয় কাত হয়ে!

আমাদের একটি ভুল ধারণা আছে, আমরা বাংলাদেশের ট্রাভেল এজেন্ট মালিকদের বলি মোয়াল্লেম; আসলে মোয়াল্লেম হলো সৌদি সরকার যে সকল লোককে হজ্জের দিনগুলোর দায়িত্ব দিয়ে থাকে তারা। যেমন আমাদের মোয়াল্লেম নাম্বার ছিল ১২৩ এবং এই মোয়াল্লেমের তত্বাবধানে মোট ৫,০০০ জন হাজী ছিল। এই পাঁচ হাজার হাজীর সমস্ত দায়-দায়িত্ব তার। বিশেষ করে, হজ্জ চলাকালীন সময়ে মিনা, আরাফা, মুজদালিফায় নিয়ে যাওয়ার বাস, সেখানকার খাওয়াদাওয়া, এরপর মিনায় আরো দুইদিনের থাকা-খাওয়া সবই তার তত্বাবধানে হয়। হাজী সাহেবদের পাসপোর্টগুলিও এই মোয়াল্লেম অফিসেই জমা রাখা হয়। মোয়াল্লেমরা টেন্ডার বা অন্য কোন সিস্টেমে সৌদি সরকারের কাছ থেকে এই দায়িত্ব পেয়ে থাকেন।

৮ তারিখ ভোরে ফজর পড়ে ঘুমালাম, ঘুম থেকে উঠে দেখি অনেক লোক পাশের পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছে। এরা সম্ভবত তালিকাভুক্ত হাজী নয়, আশপাশ থেকে হজ্জের উদ্দেশ্যে জড় হয়েছেন। তালিকাভুক্ত হতে গেলেই অনেক টাকা গুনতে হয়; তাই তারা থাকার ব্যবস্থা করেছেন পাহাড়ে আর খাওয়া হলো দোকান থেকে কেনা নানান খাবার।

দুপুরবেলা গরম তার সীমা ছাড়াল; দরদর করে ঘামছে শরীর, তাঁবুর এসিতে কাজ হচ্ছে না। বিকেল নাগাদ এক কান্ড ঘটল, প্রচন্ড ঝড় আরম্ভ হলো, সেই ঝড়ে মিনার কিছু তাঁবু উড়ে গেল, আরাফার তাঁবুগুলো শুনেছি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমি বাইরে যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম তিনটা কারনে; এক-ঝড় দেখব, দুই-এই সময় বাথরুমের সিরিয়াল থাকবেনা; আরামে ঢুকব আর তিন-পাহাড়ে অবস্থান নেয়া হাজীরা কি করছে তা দেখা!

বেরিয়েই ঝড়ের কবলে পড়লাম, অজস্র ধুলাবালি একসাথে চোখেমুখে এসে পড়তে লাগল; দমে না গিয়ে সামনে আগালাম। তাকিয়ে দেখলাম, পাহাড়ের উপর থেকে বিরাট এক ছাতে উড়ে চলে গেল। আকাশের বিজলীর চমক যেন ঢাকার আকাশের জুন মাসে বিজলী, ভয় ধরে যায়। ফ্রেসরুম থেকে বেরিয়ে পাহাড়ে তাকিয়ে দেখি, হাজী সাহেবরা একইরকম বসে আছেন, নির্বিকার। তাদের কোন ভয় নেই, তাড়াহুড়া নেই, এই বিজলীর যথেষ্ট ক্ষমতা নেই তাদের মনে ভয় ধরাবার! মিনার তাঁবুর খুঁটিগুলো স্থায়ী আর শক্ত বলে এ যাত্রায় বেঁচে গেছি। রহমতের বৃষ্টি হয়েছে বেশ ক’ফোঁটা; সেটুকু গায়ে লাগিয়ে নিতে ভুল করিনি।

রাতটি মিনার তাঁবুতে কাটিয়ে পরদিন সকাল ৮ টায় বের হলাম, বাস পেলাম ১০টায়, দুপুর বারোটার আগেই আরাফায় পৌঁছে গেলাম। নিজেদের তাঁবু খুঁজে পেতে কিছু বেগ পেতে হলো। চারিদিকে কেবল সাদা আর সাদা; এরমধ্যেই দেখলাম স্টিলের এক বিরাট কনটেইনার থেকে পাকিস্তানি কর্মীরা প্লাস্টিকের খাঁচা ভর্তি করে নানান ধরনের জুস নিয়ে বের হচ্ছে আর বাংলাদেশী হাজীরা সেগুলো মাথা থেকে টেনে নামিয়ে কাড়াকাড়ি করে নিয়ে নিচ্ছেন। যেই শ্রমিকই বের হচ্ছে, তার খাঁচাই আক্রমনের স্বীকার হচ্ছে। একদল দাঁড়িয়ে গেছে এমনভাবে যে, কোন শ্রমিককেই এই জায়গা পার হতে দেওয়া যাবে না! সবচেয়ে দৃষ্টিকটু ছিল এই দৃশ্যটি।

মূল ব্যাপার হলো, এই কন্টেইনারটি হলো ১২৩ মোয়াল্লেমের হাজীদের জন্য। শ্রমিকদের দায়িত্ব হলো সব তাঁবুতে জুসগুলো পৌঁছে দেয়া, তারা এভাবে আক্রমনের স্বীকার হবে হয়ত ভাবতে পারেনি; হয়ত বলছি, কারণ এই ঘটনা প্রতিবছর ঘটে কিনা আমার জানা নেই। কোন তাঁবুতেই তারা পৌঁছতে পারছে না; আরাফার দিনের ইবাদত হয়ে গেছে জুস কালেকশন করা। আলাদা একটা জায়গা খুঁজে নিয়েছিলাম দোয়া করব বলে, তা না করে এই তামাশা দেখছি। এর মধ্যেই নিজেও দুএকটি জোগাড় করেছি, অন্যরাও এনে দিচ্ছে, এর মধ্য দিয়েই সময় এগিয়ে যেতে লাগল।

প্রিয়নবী (সাঃ) বলেছেন, আরাফায় অবস্থান করাই হলো হজ্জ্ব। এদিন আল্লাহ্‌ সবচেয়ে নীচের আসমানে নেমে আসেন, আর বান্দাদের দোয়া কবুল করতে থাকেন। একজন হুজুর বলেছেন, আরাফার দিনে খোলা আকাশের নীচে দোয়া করা সুন্নাত। আমি খোলা আকাশ খুঁজতে বের হলাম, দেখলাম সবাই নিজের নিজের আড়াল খুঁজে নিয়েছে। সবাই লুকিয়ে কাঁদতে চায়, কেউ চায় না নিজের কান্না অন্যকে দেখাতে। এর মধ্যেই এক গ্রাম্য মহিলা এসে বললেন, ভাই, যুবায়েরের হজ্জ কাফেলাডা কই? আমি দোয়ার জায়গা খোঁজা বাদ দিয়ে যুবায়েরের হজ্জ কাফেলা খুঁজতে বের হলাম এবং মহিলাকে সেখানে পৌঁছে দিলাম।

আমাদের তাঁবুর পিছনের দিকে একটি সিঁড়ি দেখতে পেলাম, এটা অনেক উঁচুতে উঠে গেছে; সেখানেও অনেক তাঁবু দেখা যাচ্ছে। আমি তার মাঝামাঝি পৌঁছে নিজের জায়গা করে নিলাম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে, এ সময়টা দোয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ; আমার অনেক কথা আল্লাহ্‌র কাছে বলার আছে! আমি আকাশের পানে চাইলাম, হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছে, পাহাড়গুলোর পাশে ঝকমকে আলো জ্বলতে শুরু করেছে, উপরে নীলাকাশ, হয়ত তার উপরেই মহান আল্লাহ্‌ আজ আরজি শুনতে বসেছেন, আমার সব কথা মনে পড়ছে না, আমি তবু অনেক কথাই বলতে চাইছি। আমি মনেপ্রাণে আমাদের দেশের শান্তির জন্য প্রার্থণা করেছি, দেশের উন্নতির জন্য প্রার্থণা করেছি; মহান আল্লাহ্‌ আমাদের এই দেশটাকে শান্তির আবাস বানিয়ে দিন।

(২০১৮ সালের লেখা; একেবারেই ব্যক্তিগত অনুভূতি, কাউকে আঘাত উদ্দেশ্য নয়। এবার বা ভবিষ্যতে যারা হজ্জ করবেন, তাদের উপকারে আসতে পারে ভেবে পুনঃপ্রকাশ। আল্লাহ আমাকে সকল প্রকার রিয়া থেকে মুক্ত রাখুন; আমীন।)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top