কাবা শরিফ তাওয়াফ – (হজ্জের দিনগুলি-৬)

কাবা শরিফ তাওয়াফ - (হজ্জের দিনগুলি-৬)

আবু জেহেলের বাড়িটাকে টয়লেট বানানো হয়েছে এখন, লোকেরা উৎসাহ সহকারে সেটা ব্যবহার করছে। তার অনতিদূরেই রয়েছে নবী (সাঃ) এর জন্মস্থান হিসেবে চিহ্নিত একটি দোতলা বাড়ি। আর এই দুয়ের ডানপাশে আছে উঁচু জায়গায় দুটি জানালা, যেখান থেকে নবীর (সাঃ) উপর এক বুড়ি ময়লা ফেলত বলে কথিত আছে! আমি জানিনা এটা আবু লাহাবের স্ত্রীর ব্যাপারটা কিনা, কারণ তিনিই চলতি পথে নবী (সাঃ) উপর ময়লা ফেলতেন! এই জায়গাগুলো সাফা-মারওয়া পাহাড়ের ঠিক পরেই, এগুলো দেখার জন্য তেমন কোন পরিকল্পনা করার প্রয়োজন নেই; চলে গেলেই হয়।

ধূমপায়ীরা অধিকাংশই ধূমপান ছাড়তে পারেন না, সৌদি আরব গিয়ে তারা প্রথমে ইতস্ততঃ করেন, পরে যখন দেখেন খোদ মক্কা টাওয়ারের নীচেই আরবীসহ অন্যান্যরা সিগারেট টানছে, তখন আর তাদের পায় কে! সাফওয়া টাওয়ারের নীচে তো রোজ মনে হয় ধূমপায়ীদের আড্ডা বসে। এই সাফওয়া মার্কেটে একদিন ঘুরতে গিয়ে দেখি এক আরবী মহিলা (মিশরী বা তুর্কিও হতে পারে) মার্কেটের দোকানের পাশে বসে সিগারেট টানছে আর ছাইগুলো পাশের ডাস্টবিনে ফেলছে; সেই দৃশ্যটা ছিল মোস্ট শকিং! মিনায়, মুজদালিফায়, এমনকি আরাফার ময়দানেও বেশ কয়েকজনকে আমি ইহরাম পরিহিত অবস্থায় ধূমপান করতে দেখেছি।

একটা মারাত্নক ভুল ধারণা চালু আছে; আমাদের দেশের লোকেরা মনে করেন মদিনায় গিয়ে ৪০ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে পড়তে না পারলেই নয়, কিন্তু এই তাড়নাটা মক্কার কাবা’য় নামাজের ক্ষেত্রে দেখা যায় না (আমার মধ্যেও যথেষ্ট আলসেমি ছিল!) অথচ কাবায় ১ রাকাত নামাজে এক লাখ রাকাত নামাজের সওয়াব আর মসজিদে নববীতে ১ হাজার রাকাতের সওয়াব! তাছাড়া, হানাফি আলেমরাও স্বীকার করেছেন, ৪০ ওয়াক্ত নামাজ পড়ার সাথে হজ্জের কোন সম্পর্ক নেই বা এই সংক্রান্ত হাদিসটিও সহীহ নয়।

যদিও অনেক ভিন্নতা সেখানে চোখে পড়ে, আমার অবজারভেশন বলে, এই ভিন্নতার হার কিছুতেই ৫% এর বেশী নয়! নবী (সাঃ) এর ওফাতের পর কত লোক দ্বারা এই ইসলাম পৃথিবীব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে, নানান পরিস্থিতিতে মানুষ নানান রকম শিক্ষা দীক্ষা পেয়েছে, হয়ত সেকারণেই কিছু ভিন্নতা আছে ইবাদতে; মহান আল্লাহ্‌ সমস্ত হাজীদের হজ্জ এবং ইবাদত কবুল করুন।

একদিন গভীর রাতে বেরিয়েছিলাম হাতিমে নামাজ পড়ব বলে; সেদিন রুকনে ইয়ামেনি স্পর্শ করার সুযোগ হয়েছিল। হাতিমে নামাজ পড়ার জন্য ঢুকেছি, ঠেলাঠেলির মধ্যেই নিয়ত বেঁধেছি, এক রাকাত পড়েছি, পরের রাকাত শুরু করতেই দেখি ঠেলার চোটে হাতিমের আরেক মাথায় চলে গেছি, বাকি রাকাত সেখানেই পড়েছি; এরকম হামেশাই হয় সেখানে! এক মহিলাকে দেখেছি প্রথমে দুই রাকাত পড়ে নিয়েছেন, তারপর তিনি আরো পড়তে গিয়ে ধাক্কা খেয়ে একেবারে চিত হয়ে পড়ে গেছেন! হাতিমে কিংবা হাজরে আসওয়াদের সামনে মহিলাদের দুঃসাহসিক ঠেলাঠেলি চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।

তাওয়াফের জন্য যে তিনতলা পর্যন্ত ভবন বা স্পেস তৈরি করা হয়েছে, তার ছাদ থেকে তাওয়াফের দৃশ্য দেখার আলাদা একটা মজা আছে, এটা অনেকটা নেশার মত। রাত্রিবেলা আরো সুন্দর লাগে; তাকিয়ে থাকতে থাকতেই মনে পড়ে, এই কাবাঘরের পাশেই কোন একটা জায়গায় যখন প্রিয়নবী (সাঃ) নামাজ পড়ছিলেন, তখন আবু জেহেল বলেছিল, কে পারবে মুহাম্মদের ঘাড়ে ঊটের নাড়িভুঁড়ি রেখে আসতে। এক কাফের জওয়ান তখন উটের পেট ফেড়ে নাড়িভুঁড়ি ঘাড়ে রেখে আসলে পরে নবী (সাঃ) মাথা তুলতে পারছিলেন না! তখন ফাতিমা (রাঃ) এসে সেগুলো সরিয়ে নবীকে (সাঃ) উদ্ধার করেন। শুধু এটাই নয়, আরো কত স্মৃতি আছে এই কাবাকে ঘিরে!

তাওয়াফ করার সময় যে ভুলটি কখনোই করবেন না, সেটি হলো নামাজের সময় ঘনিয়ে এলে তাওয়াফ বন্ধ করে দিন। কারণ, মানুষ মাতাফে নামাজের জায়গা দখল করার জন্য লাইন ধরে দাঁড়িয়ে যায়, ফলে তাওয়াফরত লোকেদের হাঁটার জায়গা কমে গিয়ে এক বিরাট জটলার তৈরি করে; একদিন মাগরিবের সময় দম বন্ধ হয়ে আসছিল প্রায়। মানুষ যখন নামাজের জন্য দাঁড়াতে শুরু করে, তারা বিবেচনা করেনা, এতগুলো তাওয়াফরত মানুষের যে জায়গা আটকে দিচ্ছি, তারা যাবে কোনদিক দিয়ে! মানুষ কত অস্থির, এ জায়গায় না গেলে বোঝা যাবে না।

একইরকম ঘটনা ঘটেছে একদিন ফজর পড়ে ফেরার পথে। আব্দুল আজিজ গেটের সিঁড়িতে প্রচন্ড ভিড়, লোকেরা বের হওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে, পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে। আমি জ্যামের মধ্যে পড়ে গেছি। তারপর যখন ব্যারিকেড ছেড়েছে, মানুষ ঠেলাঠেলি করে উঠতে শুরু করেছে, কোন কারণ ছাড়াই এই অস্থিরতা! এই ভিড়ের মধ্যেই এক বাচ্চা মেয়ে তার বাবার কাঁধে চড়ে বসেছে। পিতা কন্যাকে কাঁধে নিয়ে একেকটা সিঁড়ি উঠছেন আর কন্যার মাথার চুলগুলো ঘোড়ার কেশরের মত দোল খাচ্ছে; তাকে লাগছে ঘোড়সওয়ারের মত। ভিড়ের মধ্যেই মনে হলো, আমার এই সাইজের একটি মেয়ে থাকলে তাকেও এমনি কাঁধে চড়াতাম, আমি হতাম ঘোড়া আর সে হতো ঘোড়সওয়ার!

এর মধ্যেই একদিন আম্মার শখ হয়েছে তিনি জাবালে নূর পর্বত দেখতে যাবেন, যে পর্বতের চূড়ায় রয়েছে হেরা গুহা! তিনি সেখানে গিয়ে পাহাড়ের দিকে নজর করে বসে পড়লেন; পাহাড়ে ওঠা দূরে থাক, পাহাড়ের পাদদেশেই যাওয়ার ক্ষমতা উনার নেই। এক বাংলাদেশীর দোকানে আম্মাকে বসিয়ে রেখে ওঠা শুরু করলাম, এত কাছে এসে হেরা গুহা না দেখে চলে যাব! এত কষ্ট হবে সেখানে উঠতে কল্পনাও করিনি; ১৪০০ বছর আগে, যখন এমন পাথরের সিড়ি ছিলনা, ব্যাল্যান্স রাখার জন্য লোহার রেলিং ছিলনা, তখন কেমন করে মা খাদিজা নবীর (সাঃ) জন্য খানা নিয়ে উঠতেন সেটা ভাবলে যে কারো মাথা ঘুরতে শুরু করবে। পুরুষ, মহিলা, বুড়ো-বুড়ি জানপ্রাণ দিয়ে উঠে যাচ্ছে সেখানে আর জড়িয়ে পড়ছে নানান বিদআতে; সেখানে আসলে কোন ইবাদত নেই। হেরা গুহার পথে কিছু কবুতর চোখে পড়বে, আরো চোখে পড়বে কিছু বানর, আছে বেশ ক’জন ফকির আর তাসবিহ ও আংটি বিক্রেতা। এক যুবককে দেখলাম মার্কার পেন দিয়ে নিজের নাম পাথরে লিখে বিদায় নিল, কি উদ্দেশ্য তা বোঝা গেল না! হেরা গুহার পাশ থেকে সমস্ত মক্কা নগরীটি দেখা যায়, দূরের মক্কা টাওয়ারটিও স্পষ্ট দেখা যায়। গুহার মুখে অসম্ভব ভিড়; পাশেই পাথরে লেখা রয়েছে ‘ইকরা বিসমি রাব্বিকাল্লাজি খালাক… ধীরে ধীরে নেমে এলাম সেই পাহাড় থেকে, যেখান থেকে সূচিত হয়েছিল আমাদের জীবন বিধান!

(২০১৮ সালের লেখা; একেবারেই ব্যক্তিগত অনুভূতি, কাউকে আঘাত উদ্দেশ্য নয়। এবার বা ভবিষ্যতে যারা হজ্জ করবেন, তাদের উপকারে আসতে পারে ভেবে পুনঃপ্রকাশ। আল্লাহ আমাকে সকল প্রকার রিয়া থেকে মুক্ত রাখুন; আমীন।)

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top