মাতাফ – (হজ্জের দিনগুলি-৪)

মাতাফ - (হজ্জের দিনগুলি-৪)

তাওয়াফের ময়দান (মাতাফ) এক অদ্ভুত জায়গা; এখানে যে কতকিছু দেখা যায় তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। বাংলাদেশীরা ছাড়া অন্য প্রায় সব দেশের লোকেরা প্রায় সবসময়ই দলবেঁধে তাওয়াফ করতে আসে; তাদের একজন দোয়া পড়ে আর বাকিরা তার সাথে তাল মিলায়। এরকম দলে সদস্য সংখ্যা ৪/৫ থেকে শুরু করে ৪০/৪৫ জন পর্যন্ত হয়। বিষয়টা খুব সুখকর নয়, তবে ইউনিটিটা চোখে পড়ার মত। ২৮ দিনে কেবল একটি বাংলাদেশী দলকে এভাবে তাওয়াফ করতে দেখেছি।

একটা মিথ চালু আছে; মাঝেমাঝেই ইন্টারনেটে দেখা যায় কাবা’র ছবি আর সেখানে লেখা থাকে ‘কেন কাবা’র উপর দিয়ে কখনো কোন পাখি উড়ে যেতে পারে না’! একেবারেই বাজে কথা; আমি নিজে বেশ কয়েকদিন ফজরের ওয়াক্তে দেখেছি, ছোট ছোট অনেক পাখি হরদম কাবা’র উপর দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

এখানে নিগ্রোদের যে দৌরাত্মের কথা শুনেছি, তা বাড়াবাড়ি মনে হয়েছে, নিগ্রোরা অনেক সংযত ছিল বলেই আমার মনে হয়েছে। তার চেয়ে বরং আরবী বুড়ো মহিলাদের ঠেলাঠেলিই আমার কাছে কষ্টকর ও বিরক্তিকর মনে হয়েছে। সবাই যদি একটা ছন্দে হাঁটে তাহলেই আর কোন সমস্যা থাকে না, কিন্তু এর মধ্যেই কিছু আছে যারা অন্যদের ঠেলে সামনে এগোতে চায়, এরাই যন্ত্রণাটা দেয়; এদের মধ্যে পাকিস্তানিদের হার উল্লেখযোগ্য।

নানান বয়সের নারী-পুরুষ পাশাপাশি তাওয়াফ করছে, কোথাও কোন অশ্লীলতা নেই। কত কত বাচ্চারা পিতার কাঁধে বসে তাওয়াফ করছে তার ইয়ত্তা নেই। কেউ কেউ কাঁধে বসে হাসছে, কেউ কেউ ঘুমাচ্ছে। অনেক বাচ্চা পিতামাতার হাত ধরে হাঁটছে, এক বাচ্চা তার পিতার সাথে সাথে দোয়া পড়ছে; পিতা বলছে রাব্বানা…পিচ্চি বলছে রাব্বানা, পিতা বলছে আতিনা…পিচ্চি বলছে আতিনা, এভাবে ‘আজাবান্নার’ বলা শেষ হওয়ার সাথে সাথে পিচ্চির চাওয়া “এবার চকলেট”! তাওয়াফের কি শর্ত!

এক নিগ্রো অন্ধকে দেখেছি লাঠি ঠকঠক করে তাওয়াফ করতে, পা-বিহীন একজনকে দেখেছি ল্যাংড়াতে ল্যংড়াতে তাওয়াফ করতে আর একজন নিগ্রোকে দেখেছি পিঁড়ির নিচে চাকা লাগিয়ে তাতে বসে তাওয়াফ করতে; এগুলো আবেগ জাগানিয়া দৃশ্য। যতই ভিড় হোক না কেন হাজী সাহেবরা তাদেরকে শ্রদ্ধাভরে জায়গা ছেড়ে দিয়েছেন। অনেকেই তাদের এক/দুই রিয়াল করে দান করেছেন; তারা আপত্তি করেননি।

বিচিত্র পোশাক পরে লোকেরা এখানে তাওয়াফ করে, পাজামা-পাঞ্জাবি, জোব্বা, জিন্স-টিশার্ট, লুঙ্গি-পাঞ্জাবি, লুঙ্গি-ফতুয়া, শার্ট-প্যান্ট ইত্যাদি। অনেক মহিলাই নামেন বোরখা ছাড়া শুধু বাসাবাড়িতে পরেন এমন থ্রি-পিস পরে; বাংলাদেশী এবং ভারতীয়রা এখানে উল্লেখযোগ্য! কিছু কিছু মহিলা পরেন প্যান্ট বা ট্রাউজারের সাথে লম্বা জামা আর স্কার্ফ। নিগ্রোদের জামাগুলি চোখে পড়ার মত; বিচিত্র তার রঙ, তারও চেয়ে বিচিত্র তার ঢং, অধিকাংশের পোষাকে দেশের নাম উল্লেখ করা থাকে।

মোবাইল বিড়ম্বনা যতটা ভাবা হয়, ততটা নয়। ১% এরও কম মানুষ মোবাইল নিয়ে সেখানে সেলফি বা ভিডিও করায় ব্যস্ত থাকে, এটা উল্লেখযোগ্য কোন সংখ্যা নয়। একদিন ফেরার পথে দুই নিগ্রোকে দেখেছি সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে খুব কসরত করে কাবা’র ছবি তুলছে। তাকিয়ে দেখি, তাদের মোবাইলটা স্মার্টফোন তো নয়ই, বরং এতই পুরোনো আর চল্টা ওঠা যে এতে যে ছবি তোলা যায় সেটাই বিস্ময়; কিন্তু তাদের আগ্রহ আর ভালোবাসার কমতি নেই।

সাধারনভাবে নিগ্রোদের মানুষ নানানভাবে সাহায্য সহযোগিতা করার চেষ্টা করে থাকেন সেখানে। এর মধ্যেই একদিন বাদশাহ ফাহাদ গেট দিয়ে বের হচ্ছিলাম, আমার সামনে দিয়ে হাঁটছেন এক নিগ্রো। নাদুস-নুদুস শরীর, পোষাক খুব উন্নত কিছু নয়, হাতে একজোড়া স্যান্ডেল। গেট থেকে বেরিয়ে আব্দুল আজিজ চত্তরে নেমেই তিনি হাতের লাল স্যান্ডেলজোড়া ফ্লোরে ফেলে পায়ে পরে নিলেন; স্যান্ডেল জোড়াও খুব নতুন কিছু নয়। কিন্তু এই লোকটিই খানিক এগিয়ে বাংলাদেশী এক ক্লিনারের হাতে যখন একটা নোট গুঁজে দিলেন তখন বিস্ময়ের আর অন্ত রইল না! এমন দৃশ্য মক্কায় মোটেই দেখা যায় না, দেখা যায় বরং উল্টোটা; জগতের সব রহস্য সবসময় বোঝা যায় না।

(২০১৮ সালের লেখা; একেবারেই ব্যক্তিগত অনুভূতি, কাউকে আঘাত উদ্দেশ্য নয়। এবার বা ভবিষ্যতে যারা হজ্জ করবেন, তাদের উপকারে আসতে পারে ভেবে পুনঃপ্রকাশ। আল্লাহ আমাকে সকল প্রকার রিয়া থেকে মুক্ত রাখুন; আমীন।)

2 thoughts on “মাতাফ – (হজ্জের দিনগুলি-৪)”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top