কাবাচত্তর – (হজ্জের দিনগুলি-৩)

কাবাচত্তর - (হজ্জের দিনগুলি-৩)

হযরত আদম (আঃ) ও হযরত হাওয়া (আঃ)-এর পৃথিবীতে মিলন হলে তারা উভয়ে আল্লাহর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। ইবাদতের জন্য একটি মসজিদ হযরত আদম (আঃ) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন। আল্লাহ তাদের দোয়া কবুল করেন এবং বাইতুল মামুরের আকৃতিতে পবিত্র কাবাঘর স্থাপন করেন। এখানে হযরত আদম (আঃ) সন্তুষ্টচিত্তে আল্লাহর ইবাদত করতে থাকেন।

পরবর্তীতে অনেক সংস্কারের মধ্য দিয়ে কাবাঘর তার বর্তমান আকৃতি লাভ করেছে, বর্তমান কাবা কমপ্লেক্সটি প্রায় ৮৮.২ একর জায়গা জুড়ে রয়েছে। কাবাবাঘরের আকৃতি ঘনকের মত, উচ্চতায় এটি আমাদের দেশের তিনতলা বিল্ডিং এর চেয়ে সামান্য বড় হবে। পাথর নির্মিত এই ঘরের উপরের অংশ কালো সিল্কের উপরে স্বর্ণ-খচিত ক্যালিগ্রাফি করা কাপড়ের গিলাফে আবৃত থাকে। কাছ দিয়ে গেলে এই কাপড়ের উপর সারিবদ্ধভাবে আরবীতে ‘আল্লাহু’ লেখাটি চোখে পড়ে।

কাবাঘরের একটি কোনে লাগানো আছে বেহেস্তি পাথর ‘হাজরে আসওয়াদ’, এ কোনাটির নাম ‘রুকন-আল-আসওয়াদ।’ এরপরের কোনাগুলি হল রুকন-আল-ইরাকী, রুকন-আল-শামি এবং রুকন-আল-ইয়ামানি। সহিহ হাদিস থেকে জানা যায়, “যে ব্যক্তি রুকন-আল-ইয়ামানি ও হাজরে আসওয়াদ স্পর্শ করবেন, তিনি জান্নাতে যাবেন।” এই কারণে, এই দুইজায়গায় সবচেয়ে বেশী ভিড় হয়, বিশেষতঃ হাজরে আসওয়াদকে চুমু খাওয়ার জন্য সেখানে কি কি ঘটনা ঘটে, সেটা বলব আরেকদিন!

কাবাঘর ও তৎসংলগ্ন কিছু জায়গা আছে যেখানে দোয়া কবুল হয়; এমন কিছু জায়গা হলোঃ হাজরে আসওয়াদ, মুলতাজাম (হাজরে আসওয়াদ ও কাবার দরজার মধ্যবর্তী জায়গা), কাবার দরজার চৌকাঠ, হাতিম (অর্ধচন্দ্রাকৃতির জায়গা), মাতাফ (তাওয়াফ করার স্থান), মুসতাজার (রুকনে ইয়ামানির বাম পাশের জায়গা), পিঙ্ক কালারের পিলার (রুকনে ইয়ামানি বরাবর – এখানে মিরাজের রাতে নবী (সাঃ) শায়িত ছিলেন; আব্দুল আজিজ গেট দিয়ে ঢুকে মাতাফে নেমে হাতের বামে তাকালেই চোখে পড়ে), সাফা পাহাড়, মিলাইন আখজারাইন (সাফা-মারওয়ার মধ্যবর্তী প্রায় ৪৪০ গজ পথের মধ্যে যে ৪০ গজ পুরুষদের দৌড়ে পার হতে হয়), মারওয়া পাহাড় ও মুসাল্লায়ে জিবরাঈল (ক্বাবাঘরের দরজার ডানে।) এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও কমেন্টবক্সে দিলাম, দেখে নিতে পারেন।

সমস্ত কাবাচত্তর নানান ধরনের বিদআতে ভরপুর; লোকেরা রুকন-আল-ইরাকি ও রুকন-আল-শামি ধরেও কান্নাকাটি করছে, ক্বাবাঘরের যেকোন জায়গায় সাদা রুমাল ঘষছে আর সেটি দিয়ে পরে মুখ মুছছে, এরকম আরো অনেক মানবরচিত ইবাদত পদ্ধতি বা আবেগের বশে করে ফেলা কাজ সেখানে হয়। নারীদের জন্য সেখানে সুনির্দিষ্ট নামাজের জায়গা না থাকলেও পুলিশ নারীদের জন্য কিছু কিছু ব্লক তৈরি করে দেয়, তারপরেও অনেক নারী-পুরুষ পাশাপাশি নামাজ পড়ে; এটা জায়েজ নয়। আলেমরা বলেছেন, একজন নারীর দুইপাশের দুই পুরষ ও পিছনের পুরুষের নামাজ হবে না।

মাতাফের জায়গাটি একটি ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সমান বড়। টাইলস বিছানো চত্তরে গোল করে দাগ কাটা আছে, যেখানে মুসল্লীরা নামাজের জন্য দাঁড়ায়। কাবাঘরের কাছেই আছে মাক্কামে ইব্রাহিম, যেখানে ইব্রাহিম (আঃ) এর পায়ের ছাপ রাখা আছে। লোকেরা এখানেও ধরে কান্নাকাটি করে; এটা জায়েয নেই। মাক্কামে ইব্রাহিম সোজা মাতাফের শেষদিকে তাওয়াফের সুন্নাত নামাজ পড়ার জায়গা আছে, যদিও এখানে জায়গা পাওয়া সহজ নয়। ফলে, লোকেরা তাওয়াফের পর যে যেখানে পারে দাঁড়িয়ে যায় আর অন্যরা বাধ্য হয়েই তাদের সামনে দিয়ে যাতায়াত করে। আরেকটা গর্হিত কাজ মক্কায় হয় সেটা হলো, হরদম লোকেরা অন্যদের নামাজের সামনে দিয়ে চলাচল করে, তবে অনেকেই আবার অন্যজনের নামাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে।

কাবাচত্তরে প্রবেশ করার অনেকগুলো গেইট থাকলেও সবচেয়ে বেশী ব্যবহৃত গেইট হচ্ছে কিং আব্দুল আজিজ গেট। এই গেইটের উল্টোদিকেই আছে বিখ্যাত মক্কা টাওয়ার যার উপর শোভা পাচ্ছে বিরাট সাইজের ঘড়ি। চারদিকে চারটি ঘড়ি লাগানো থাকার ফলে যে কোন দিক থেকে এখানে সময় দেখা যায়। সারা মক্কা শহর থেকে এই টাওয়ারটি নজরে পড়ে। এই টাওয়ার লাগোয়া আরো ক’টি টাওয়ার আছে যেমন, সাফওয়া টাওয়ার, জমজম টাওয়ার ইত্যাদি এবং এই টাওয়ারগুলোর প্রত্যেকটির নিজস্ব মার্কেট আছে। আর এই টাওয়ারের পাশেই আছে বিখ্যাত কবুতর চত্তর। মক্কা টাওয়ারের পরের টাওয়ারটিই বিখ্যাত হোটল হিলটন; এই হোটেলের দোতলায় ম্যাকডোনাল্ডস ও নীচতলায় কেএফসি’র ফাস্টফুডের দোকান আছে। মক্কা টাওয়ারসহ যে ছবি আমরা ইন্টারনেটে পাই তাতে আব্দুল আজিজ চত্তর, তাওয়াফের জন্য তৈরিকৃত চারতলা স্পেস, মাতাফ ও ক্বাবাঘর সবসহ দেখায় বলে দৃশ্যটা দেখতে অনেক সুন্দর লাগে।

যত টয়লেট আছে সব ক্বাবাচত্তরের বাহিরে; পুরুষ ও মহিলাদের জন্য আলাদা আলাদা টয়লেটের ব্যবস্থা। টয়লেট গ্রাউন্ডে ঢুকে এস্কেলেটর দিয়ে নীচে নেমে তবেই টয়লেটে যেতে হয়, কারো কারো জন্য এস্কেলেটর ভয়ের কারণ বৈকি। সবাই সামনের দিকের টয়লেটে যেতে চায় বলেই ভিড় বেশী, একটু সামনে এগোলেই ফাঁকা টয়লেট পাওয়া যায়। তবে মাতাফের পিছনে পুরুষ ও মহিলাদের জন্য শুধু ওযুর ব্যবস্থা আছে।

কাবাচত্তরের নানান জায়গায় রয়েছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ পানি জমজমের কল, যে গেট দিয়েই আপনি প্রবেশ করেন না কেন জমজমের কল পাবেন। এই পানি অত্যন্ত সুস্বাদু; এতে রোগের আরোগ্য হয়। হাদিসে আছে, রাসুল (সাঃ) কাবা থেকে ফেরার পথে রোগীদের গায়ে জমজমের পানি ছিটিয়ে দিতেন। সাধারণত প্রায় সব কলে বরফ ঠান্ডা পানি বের হয়, নরমাল পানি পেতে হলে খুঁজে বের করতে হবে। সাধারণত ভ্রাম্যমাণ যে পানির কন্টেইনারগুলো থাকে সেখানে Not Cold লেখা নরমাল পানি পাওয়া যায়। দিনের বেলা, যখন সূর্যের তাপ অত্যধিক বেড়ে যায় তখন কিছু কিছু শ্রমিক পিঠে পানি বোঝাই ট্যাংকি থেকে তাওয়াফরত হাজীদের হেঁটে হেঁটে পানি পান করায়। হাজী সাহেবরা বোতল ভরে জমজমের পানি রুমে নিয়ে যায় আবার আসার সময় খালি বোতল নিয়ে আসে; এই প্রক্রিয়া চলমান।

বোরকাবৃত হয়ে কিছু মহিলা ভিক্ষা করতে আসে এখানে, এরা হিন্দি বা উর্দুতে কথা বলে। মক্কা বা মদিনার রাস্তায় নিগ্রো ভিক্ষুক দেখা খুব অস্বাভাবিক নয়; কেউ কেউ তাওয়াফের সময় বা চলতিপথেও সাহায্যের জন্য হাত পাতে। একাধিকজনকে দেখেছি আব্দুল আজিজ গেইটের চত্তরে মাগরিবের আগে ভিক্ষা করতে।

মক্কায় ফুটপাতে কোন কিছু বিক্রি করা নিষেধ, ফলে নিগ্রো এবং যেসব আরবী সেখানকার ফুটপাতে ফলমূল ও অন্যান্য দ্রব্য বিক্রি করে তারা সবসময় উৎকণ্ঠিত থাকে পুলিশের ভয়ে। একটি আরবী পরিবারকে দেখেছি প্রতিদিন ফুটপাতে জায়নামাজ বিক্রি করতে; পিতা, দুই কন্যা ও এক পুত্র। তাদের জায়নামাজগুলির কোয়ালিটি ভালো নয়; দুটি জায়নামাজ পনেরো রিয়াল! কিন্তু ছোট দুটি বোন আর তারও ছোট ভাইটি মিলে আমাদের গুলিস্তানের মত খুব ডাকাডাকি করতো; দো পনেরো রিয়াল…দো পনেরো রিয়াল…তারা হিন্দি জানেনা তবু জীবিকার প্রয়োজনে এটুকু শিখে নিয়েছে। কখনো কখনো তারা পনেরোর পরিবর্তে ‘খামাস্তাস’ শব্দটি ব্যবহার করত। একদিন দেখি দুই বোন মিলে জায়নামাজের চাদর গুটিয়ে ধরে জানপ্রাণ দিয়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে; বুঝলাম পুলিশ ধাওয়া করেছে।

টানা একমাস এই বাচ্চাগুলোকে দেখেছি, তাদের চোখে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেছি, পুলিশের ভয় দেখেছি, পরিবারের জন্য কর্তব্যপরায়ণতা দেখেছি, পিতার অসহায়তায় বিরাগভাজন না হয়ে পিতাকে সাহায্য করতে দেখেছি; অনেক কিছুই ভুলে যেতে বসেছি, তবু আজ এদ্দিন পরেও যেন কানে বাজছে আরবী কিশোরী আর শিশুকন্ঠের সম্মিলিত চিৎকার ‘দো পনেরো রিয়াল…দো পনেরো রিয়াল!’

(২০১৮ সালের লেখা; একেবারেই ব্যক্তিগত অনুভূতি, কাউকে আঘাত উদ্দেশ্য নয়। এবার বা ভবিষ্যতে যারা হজ্জ করবেন, তাদের উপকারে আসতে পারে ভেবে পুনঃপ্রকাশ। আল্লাহ আমাকে সকল প্রকার রিয়া থেকে মুক্ত রাখুন; আমীন।)

1 thought on “কাবাচত্তর – (হজ্জের দিনগুলি-৩)”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top