ট্যাক্সি সিসলি থেকে গালাতা টাওয়ার পর্যন্ত চাইলো ২৫০ লিরা, অথচ মোবাইলে দেখাচ্ছে ৩৭-৪৪ লিরা লাগবে! মাত্র ৫ কিমি রাস্তা ২৫০ লিরা দিয়ে যেতে মন সায় দিচ্ছিল না। আরেকজনকে থামালাম, সে চাইল ২০০ লিরা! তখন আমাকে উদ্ধারকার্যে এগিয়ে এলো ফেসবুক বন্ধু ও ছোটভাই মেহেদী।
মেহেদীকে ফোনে ঘটনা জানালাম; সে বলল, ভাইয়া ইস্তাম্বুলের ট্যাক্সি ড্রাইভাররা ডাকাত! আপনি যেখানে আছেন, সেখান থেকে কয়েকগজ সামনে মেট্রো স্টেশন আছে। আপনি নীচে নেমে একটা কার্ড করে ফেলেন, এরপর এটা দিয়ে সারা শহর ঘুরে বেড়াতে পারবেন। আমি সেই মোতাবেক মেট্রো স্টেশন খুঁজতে শুরু করলাম!
যাব্বাবা! এ যে দেখি, বাড়ির পাশে আরশিনগর! আমি যেখানে দাঁড়িয়ে ট্যাক্সি দরদাম করছিলাম, সেখান থেকে ২০ গজের মধ্যেই ‘ওসমান বে’ মেট্রো স্টেশন; সুবিশাল এর আয়তন। নীচে নেমে দুজনকে বললাম হেল্প করতে; তারা আমার ইংরেজি বুঝল না। এরপর একটা লম্বা গড়নের ছেলেকে বললাম, সে চমৎকার ইংরেজি বলে। সে এসেছে বুরসা থেকে, এখন সে ইস্তাম্বুলের একটা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে।
৫০ লিরা দিয়ে সে একটা কার্ড করে দিল এবং এরপর ১০০ লিরা রিচার্জ করে দিল। এখানে কঠিন হলো, এই মেশিনগুলোতে টার্কিশ ভাষা দেখায়, ফলে টার্কিশ না জানলে কার্ড করা বা রিচার্জ করা কঠিন। মেশিনে ভাষা চেঞ্জ করা যায় কিনা, আমার জানা নেই।
মেট্রোতে এর আগে চড়েছি সিঙ্গাপুরে এবং কলকাতায়, অতএব এখানে সংকোচের কিছু নেই। আবার জিগ্যেস করে করে কাঙ্ক্ষিত রুটে চলে গেলাম; মেহেদী শিখিয়ে দিয়েছে, সিশেন স্টেশনে নামতে! পরের কয়েকদিনে নামগুলো পরিচিত হয়ে গিয়েছিল! আমার স্টেশন হচ্ছে ওসমান বে, এরপর তাকসিম, তারপর সিশেন ও তার পরে হালিজ!
সিশেন স্টেশনে যখন নেমেছি ততোক্ষণে বিকেল ৫ঃ০০ টার মত বাজে; উপরে উঠে দেখি এক অদ্ভুত সুন্দর প্রশস্ত জায়গা। ঠান্ডা বাতাস বইছে, কোন বাড়তি শব্দ নেই, চত্তরের পাশে গ্যালারির মত বসার জায়গা রয়েছে, অনেকেই সেখানে গল্প করছে। সামনে এগিয়ে রাস্তা পেরোলে ঐ দূরে সাগরের ওপারে ইস্তাম্বুল শহরের গর্বিত অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। এর পাশেই অনেকগুলো এটিএম বুথ আছে তবে এ শহরে এটিএম বুথগুলো ওপেন থাকে!
এই চত্তর থেকে সামান্য বাঁয়ে গেলেই পাওয়া যায় বিখ্যাত গালাতা টাওয়ার। একটা টাওয়ার কেন এত বিখ্যাত, এই প্রশ্ন মনে ছিলই; মনের প্রশ্ন মনে নিয়ে এগোলাম। টাওয়ারের ভিতরে ঢুকে লিফটে ৭ম তলায় উঠে দেখলাম এক সুন্দর রেপ্লিকা; গোটা ইস্তাম্বুল শহরটাকে তারা এখানে ধারণ করেছে; মুন্সিয়ানা আছে বটে!
রেপ্লিকা থেকে চোখ ফিরিয়ে দেখি কাঁচের ভিতর দিয়ে গোটা ইস্তাম্বুল শহর দেখা যাচ্ছে। যেহেতু গালাতা টাওয়ার সিলিন্ডার আকৃতির, ফলে এখানে থেকে ৩৬০ ডিগ্রি এংগেলে গোটা ইস্তাম্বুল শহর দেখা যায়। আমি কাঁচের সাথে চোখ লাগিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম; মাঝারি মানের লাগলো। জায়গায় জায়গায় বড় বড় দূরবীন লাগানো; আমি দূরবীনে চোখ রাখতে গিয়ে দেখলাম, চশমার জন্য চোখ রাখা যাচ্ছে না আর চশমা খুললে দূরবীনে কিছু দেখা যাচ্ছে না!
এই যখন অবস্থা, তখনো জানি না, আমার জন্য কি বিস্ময় অপেক্ষা করছে! সবাই দেখলাম সিঁড়ি বেয়ে উপরে যাচ্ছে, আমিও তাই গেলাম; সুবহানাল্লাহ! এ কি দেখছি আমি! এখানে দুই পাশে দুটি দরজা খোলা; এই দরজা দিয়ে বাইরে বেরোলে একটি বারান্দা পাওয়া যায়, সেটি পুরো টাওয়ারকে ঘিরে রয়েছে, যে কোন দর্শণার্থী এটি ঘুরে আসতে পারে এবং পারে গোটা ইস্তাম্বুলকে একসাথে দেখতে!
এ দৃশ্যের সৌন্দর্য লিখে বা বলে বোঝানো যাবে না; ইস্তাম্বুল এমনিতেই আলোর শহর, অবাক হতে হয়, কত আলোকজ্জল হতে পারে একটি শহর যেটি পুরোটাই সাগরের পাড়ে, আবার সেই সাগরের মাঝ দিয়ে বয়ে চলেছে অজস্র জাহাজ, ঐ দূরে দেখা যাচ্ছে অনেক বড় মিনারওয়ালা মসজিদ আর একপাশ থেকে উঁকি দিচ্ছে বসফরাস ব্রীজ!