টার্কিশ পিপল লাভ মানি – (ইস্তাম্বুলের অভিযাত্রী-৯)

টার্কিশ পিপল লাভ মানি - (ইস্তাম্বুলের অভিযাত্রী-৯)

এই শহরের লোকদের মধ্যে তেমন কোন সালামের প্রবণতা দেখিনি তবে এক বিড়িখোরকে আরেক বিড়িখোরের কাছে আগুন চাইবার সময় লম্বা করে ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলতে শুনেছি, ঘটনা একেবারে আমার সামনে; বিড়িখোরেরা অনেক আগে থেকেই আত্মার আত্মীয়!

ইস্তাম্বুলের লোকজনের মধ্যে ভালো এবং মন্দের মিশেল আছে; টাকার জন্য এত এগ্রেসিভ জাতি আমি আর কোথাও আছে বলে শুনিনি! একটা গোষ্ঠীর মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ ঠকানোর প্রবণতা রয়েছে; এরা ওঁত পেতে থাকে এবং কেউ বিদেশী এটা বুঝতে পারলে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

আমি যেটা শুনলাম, গোটা তুরষ্কের কালচার থেকে ইস্তাম্বুল আলাদা। তুর্কিরা খুবই অতিথিপরায়ণ এবং হেল্পফুল কিন্তু ইস্তাম্বুল এসব থেকে আলাদা; এখানে টাকা ছাড়া মানুষ আর কিছু বোঝে না, সিরিয়ান যুবক জোয়াইনের মতে, “টার্কিশ পিপল লাভ মানি”!

তৃতীয় দিন যখন ওসমান-বে থেকে গালাতা টাওয়ার মাত্র ৫ কিমি যাবার জন্য ট্যাক্সি থামিয়েছি, ড্রাইভার বলল, ২৫০ লিরা বা ১,৫০০ টাকা লাগবে! অথচ মোবাইলে দেখাচ্ছিল, লাগবে ৩৭-৪৪ লিরার মধ্যে; এরা ট্যুরিস্ট দেখলে এভাবে আক্রমণ করে!

এরপর দ্বিতীয় আরেকটি ট্যাক্সি ডাকলাম, সে ফিক্সড ২০০ লিরা বলে দিল। তখন উপায় না দেখে ফেসবুক বন্ধু ও ছোটভাই মেহেদীকে ফোন দিলাম, সে বলল, আপনি যেখানে আছেন, সেখানেই মেট্রো স্টেশন আছে, নীচে নেমে একটা কার্ড কিনে মেট্রোতে চলে যান। পরে তাই করেছি।

গালাতা টাওয়ারের কাছে গিয়ে এক হকারকে জিগ্যাসে করলাম, দূরের ঐ মসজিদটার নাম কি? সে নাম বলে তারপর আমাকে বলল, আমাকে কিছু সাদাকা দাও!

টপকাপি মিউজিয়াম দেখার সময় অনেকেই টার্কিশ গাইড নিয়ে যায় যারা ভালো ইংরেজি জানে; তেমনই এক গাইডের বক্তব্য শুনছিলাম এবং হারেম দেখার সময় হটাত একটি প্রশ্ন মাথায় এলে আমি ওনাকে জিগ্যেস করলাম। তিনি উত্তর না দিয়ে আমাকে জিগ্যেস করলেন, তুমি কি আমার সাথে থাকতে চাও? তাহলে ১০০ ডলার দিতে হবে! অর্থাৎ তিনি টাকা ছাড়া আমার প্রশ্নের উত্তর দিবেন না!

এখানে ডোনার বা শর্মা বিক্রি হয় ২৫-৫০ লিরায় (সিংগেল ও ডাবল), ফান্টা ২৫ লিরা, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই ২৫-৪৫ লিরা! আমি একদিন হোটেল থেকে এই তিনটা আইটেম অর্ডার করেছিলাম হোটেল কর্তৃপক্ষের মাধ্যেমে। কোন ভাউচার না দিয়ে আমার কাছে বিল ক্লেইম করেছে ১৮৫ লিরা! এখানে ফাঁকিটা ছিল, খাবারের সাথে দাম উল্লেখ করা ছিল না ( কিন্তু কুরিয়ার ফ্রি ছিল)! এত দাম কিছুতেই হবার কথা না।

শেষদিন যখন হাতে থাকা লিরা ফেরত দিয়ে ডলার নিতে গেছি, আমি দিয়েছি তাদের ১৩৩৮ লিরা, সে আমাকে দিল ৭০ ডলার। ডলার নেয়ার পর আমি জিগ্যেস করলাম, কত করে ধরেছে সে, বলল ১৮.৮৪ করে। আমি মোবাইল বের যেই ভাগ করা শুরু করেছি, অমনি সে ১৬ লিরা বের করে দিল। এর আগে কিন্তু চুপ মেরে বসেছিল!

প্রায় প্রত্যেকটা ক্ষেত্রেই সুযোগ পেলেই ঠকায়! এ এক আজব টেন্ডেন্সি; বিশেষ করে সেলসম্যানদের কাছে ইংরেজিতে কিছু জিগ্যেস করলে আর রক্ষা নেই। আমার জর্ডানিয়ান ট্রেইনার এমন অনেক পরিস্থিতির স্বীকার হয়েছেন গত এক বছরে।

আরেকটা দেখেছি, কিশোরী, বাচ্চাসহ যুবতী মেয়েরা ভিক্ষা করছে, বুড়ো-বুড়ীরা ভিক্ষা করছে। মনে হয়, বিদেশী দেখলে হাত পাতার প্রবণতা বেড়ে যায়। অতিরিক্ত অর্থলিপ্সা এদের মধ্যে নৈতিক অবক্ষয় সৃষ্টি করেছে।

তবে, কয়েকজনের খুব আন্তরিক সাহায্য পেয়েছি, এটি না বললে অন্যায় হবে; বুরসা থেকে আসা একটি ছেলে আমাকে মেট্রোর কার্ড কিনতে এবং লিরা রিচার্জ করতে সহায়তা করেছে, ট্রামে এক যুবক আমাকে লোকেশন গাইড করে খুবই হেল্প করেছে এবং এক যুবক একদিন হালিজ থেকে রীতিমত পথ দেখিয়ে আমাকে তাকসিম নামিয়ে দিয়ে গেছে!

জিনিসপত্রের দাম বেশী এবং জীবন কম্পিটিটিভ হবার কারনে অনেকের মধ্যে ঠকানোর প্রবণতা এসেছে, তাছাড়া এখানে প্রচুর ইউরোপিয়ান ও আমেরিকান ট্যুরিস্ট আসে যারা টাকা পয়সা সেভাবে হিসাব করে না, এটাও একটা কারন হতে পারে কিন্তু ইস্তাম্বুলের যে ইতিহাস ও ঐতিহ্য, এর যে বাহারি সৌন্দর্য, এর যে আভিজাত্য তাতে কলংক লেপার জন্য এটুকু অসততা যথেষ্ট নয়!

বাই দ্যা ওয়ে, ইস্তাম্বুল সম্পর্কে ভ্রমণ বৃত্তান্ত এখনো শুরু হয়নি, আগামী পর্বে হবে ইন শা আল্লাহ। এতদিন কেবল বিভিন্ন সেগমেন্ট সম্পর্কে আমার জেনারেল অবজারভেশন জানিয়ে গেছি।

1 thought on “টার্কিশ পিপল লাভ মানি – (ইস্তাম্বুলের অভিযাত্রী-৯)”

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top