![হজ্জক্যাম্প - (হজ্জের দিনগুলি-১) 1 হজ্জক্যাম্প - (হজ্জের দিনগুলি-১)](https://shaheenstravelstory.com/wp-content/uploads/2023/09/Screenshot-2023-09-05-175718.jpg)
বিস্ময়ের শুরু হজ্জক্যাম্প থেকে; হজ্জক্যাম্পের মসজিদে অপেক্ষার সময়টুকুতে আটজনের একটি ছোট দলের সবাইকে হটাত এক ইমাম সাহেব তালবিয়া পাঠ করতে বললেন, ছয়জন-ই পারলো না। আমি ভাবলাম, এরা আর কিছুক্ষণ পর ইহরাম বাঁধবে কি করে? এই আটজন বরং দেখতে তুলনামূলক শিক্ষিত, বাকি যারা আরো প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এসেছেন, তাদের কি অবস্থা! যদিও সবকিছুর পরে কথা একটাই, ক্ববুল করার মালিক ‘আল্লাহ্’।
সৌদিয়া এয়ারলাইন্সের আয়োজন চমৎকার, ৩৮১ জন যাত্রী পেটের মধ্যে নিয়ে বোয়িং ৭৭৭ উড্ডয়ন শুরু করেছে, চমৎকার তাদের সেবা, পর্যাপ্ত টয়লেট, সুন্দর নামাজের ব্যবস্থা এবং পরিশেষে অসাধারন ল্যান্ডিং আবারো সৌদিয়ায় চড়ার আগ্রহ যোগাবে যদিও আধুনিক স্বাদের খাবার গ্রাম-গঞ্জের মানুষের খুব একটা ভালো লাগেনি।
বাসা থেকেই ইহরামের কাপড় পরে বের হয়েছি। মীকাতের (যেখানে ইহরাম বাঁধতে হয়) আগে দেখলাম নানানভাবে সতর্ক করা হচ্ছে, মোটামুটি সবাই জেগে আছে, পরিষ্কার বাংলায় মাইক্রোফোনে জানিয়ে দিল আপনারা এখন ইহরাম বাঁধতে পারেন (অর্থাৎ নিয়ত করে তিনবার তালবিয়া পড়াই হলো ইহরাম বাঁধা), আমরা দ্রুত তাই করে নিলাম।
জেদ্দা এয়ারপোর্টে নেমে যখন বাসের অপেক্ষা করছি, তখন দেখলাম অনেক মহিলা মুখে নিকাব লাগিয়ে বসে আছেন। ইহরাম বাঁধা অবস্থায় মহিলাদের মুখে টাইটভাবে কোন কাপড় লেগে থাকার বিধান নেই। এজন্য বাংলাদেশে এক ধরণের টুপি কিনতে পাওয়া যায় যার সাথে কাপড় লাগানো থাকে, এটা মাথায় পরে কাপড়টা সামনে ছেড়ে দিলে পর্দাও হয় আবার ইহরামেরও ক্ষতি হয় না। অধিকাংশ লোকই কোন পড়ালেখা বা পূর্বপ্রস্ততি ছাড়াই প্লেনে চড়ে বসে; কর্মফল নিয়তের উপর নির্ভরশীল, এই তত্বের উপর লোকেদের আস্থা অনেক বেশী!
হজ্জের নানান ধরনের প্যাকেজ হয়ে থাকে, শুরুটা বর্তমানে কমবেশী ৩.০০ থেকে ৩.২০ লাখ, এতে মক্কায় হোটেল মেলেনা, ভাড়া বাসায় থাকতে হয়। ৪.০০ থেকে ৪.৫০ লাখ টাকা দিলে হোটেল পাওয়া যায় তবে কিছুটা দূরে এবং হোটেলের মান বাসার মতোই। লাখ পাঁচেক দিলে কিছুটা ভালো মানের হোটেল এবং ক্বাবার কাছাকাছি পাওয়া যায় আর ৬-৮ লাখ টাকা দিলে ক্বাবার একেবারে কাছেই সবচেয়ে ভালো ভালো হোটেলগুলি পাওয়া যায়।
এ তথ্য আনুমানিক এবং আমার পরামর্শ, পর্যাপ্ত টাকা থাকলে খোঁজখবর নিয়ে দামী প্যাকেজেই যাওয়া উত্তম যদি থাকা-খাওয়া নিয়ে খুঁতখুঁতি থাকে। তবে বাংলাদেশের বেশীরভাগ মানুষ সর্বনিম্ন টাকার প্যাকেজেই যান এবং তারা মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সাথে বাসায় বা যেখানে ব্যবস্থা হয় সেখানে অবস্থান করেন। আরেকটা ব্যাপার আছে, হোটেল হিলটন হজের সময় চার ধরণের ভাড়া নির্ধারণ করে থাকে; প্রথমদিকে যারা যান, তারা চার লাখ টাকায়ও সেখানে থাকতে পারবেন ১৮-১৯ দিন কিন্তু হজের সময় সেখানে থাকতে অনেক বেশী টাকা গুনতে হবে।
তবে, সবার আগে যেটা খেয়াল রাখতে হবে সেটা হলো, আপনি কোন ট্রাভেল এজেন্টের সাথে যাচ্ছেন! দুষ্ট লোকজনে বোঝাই এখন বাংলাদেশের হজ্জ ট্রাভেল। পুরোপুরি সত্য কথা কয়জন বলে খুঁজে পাওয়া ভার। কেউ যদি মিথ্যা নাও বলে, ঘুরিয়ে কথা বলে। সবচেয়ে মারাত্মক, প্রত্যেক ট্রাভেল এজেন্টের মালিকের নানান দিকে এজেন্ট লাগানো থাকে, যাদের কাজ হলো হাজী যোগাড় করা। তারা প্রত্যেক হাজীর বিনিময়ে একটি হাদিয়া পেয়ে থাকেন, কেউ কেউ ফ্রি হজ্জে গমন করেন বা অন্য কোন ভাবে সুবিধা পেয়ে থাকেন।
আপনি কোন পরিস্থিতিতেই ট্রাভেল মালিকের সাথে কথা না বলে প্যাকেজে রাজি হবেন না, কারণ দিনশেষে এই এজেন্টের কথার কোন দাম নেই, মালিক যেভাবে প্যাকেজ ঠিক করে সেভাবেই সব হয়; অনেক মূল্য দিয়ে এবার আমি তা শিখেছি। ৪০ দিনের প্যাকেজের মধ্যে আমার সাথে এজেন্টের কথা হয়েছিল আমাকে ২১ দিনে ফিরিয়ে আনবে, পরে ঠিক হলো ২৮ দিনে আনবে, শেষ পর্যন্ত ৩২ দিনে আনতে সক্ষম হয়েছে, তারপরও মদিনায় আমি অবস্থান করেছি মাত্র তিন দিন। হয়ত, ট্রাভেল মালিকের সাথে কথা বললে এমন হতো না!
কেউ যদি রেগুলার কাফেলা থেকে প্যাকেজ ছোট করতে চান, এই বিষয় একেবারে পরিষ্কার করে নিতে হবে কারণ আসলেই এটা অত্যন্ত ঝামেলার কাজ। সবচেয়ে মারাত্মক হলো, ট্রাভেল মালিকের এজেন্টেরও এজেন্ট বাজারে রয়েছে, অর্থাৎ সাব কন্ট্রাক্ট নেয়ার মত। এমন একজনের ফাঁদে পড়েছেন এবার আমার কলিগ। ৫.১৭ লাখ টাকা দিয়েছেন তিনি হোটেল হিলটনে থাকবেন বলে, গিয়ে শোনেন তিনি আসলে ৩.২০ লাখ টাকার প্যাকেজে এসেছেন এবং এমনও হয়েছে হোটেল হিলটনের পরিবর্তে মক্কায় তাকে গোডাউন টাইপের একটি রুমে সস্ত্রীক থাকতে হয়েছে। আপনাকে খুঁজে দেখতে হবে, কোন ট্রাভেল এজেন্টের মালিকের ঈমান, আখলাক ও আচরণ তুলনামূলক ভালো; নইলে খবর আছে!
রাত সাড়ে তিনটায় রওনা দিয়েছিলাম, জোহরের সময় এসে হোটেলে পৌঁছলাম। হোটেলেই জোহর পড়লাম এবং এরপর লাঞ্চ করে ফরজ তাওয়াফ এবং সাঈ করতে রওনা হলাম। জিহাদ রোডে আমাদের হোটেল, সেখান থেকে দশ মিনিটের হাঁটা রাস্তা, এরপরই সেই বিস্ময়কর ঘর, যার জন্য মানুষ পাগলপারা। আম্মাকে সাথে নিয়ে হাঁটা দিলাম, উত্তেজনায় ছাতা নিতে ভুলে গেলাম। আব্দুল আজিজ গেট দিয়ে ঢোকার সময় স্যান্ডেল খুলছি, হটাত দেখি আমাদের সবাই দাঁড়িয়ে মোনাজাত ধরেছে। সামনে তাকিয়ে দেখি, ক্বাবাঘরের একাংশ দেখা যাচ্ছে! ক্বাবাঘর প্রথম চোখে পড়ার সাথে সাথে যে দোয়া করা হয় তা কবুল হয় বলে প্রচলিত আছে। বিস্ময়ের ঘোরে আমরাও মোনাজাত ধরলাম।
অতঃপর, ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে মাতাফে (তাওয়াফ করার জায়গা) নামলাম। তীব্র গরমের মধ্যেই তাওয়াফ করলাম। কত কাছ থেকে ক্বাবাকে দেখছি, এত উত্তেজনার মাঝে নিজেই ইজতিবা (ইহরামের কাপড় ডান বগলের নীচ দিয়ে নিয়ে বাম কাঁধে ফেলা) করতে ভুলে গেলাম, একজন আমাকে রমল (বীরের মত হেলেদুলে চলা) করতে দেখে সতর্ক করে দিলেন, আমি ইজতিবা করে নিলাম।
তাওয়াফ শেষে সাঈ করতে গেলাম, আম্মার কোন ক্লান্তি নেই, লম্বা জার্নি করে এসে ছাতা ছাড়া তাওয়াফ করে এবার তিনি একবারে সাফা-মারওয়া সাঈ করে ফেললেন, তিনি যেন নতুন করে প্রাণ ফিরে পেলেন। এরপর সেখান থেকে বের হয়ে আমি সেলুনে মাথা কামিয়ে হালাল হয়ে গেলাম। ধীরে ধীরে হোটেলের দিকে এগোলাম, পিছনে রয়ে গেল অনন্ত আগ্রহের ক্বাবাঘর, যার রহস্যের সামান্যতম কিনারাও এক দেখায় করতে পারলাম না!
(২০১৮ সালের লেখা; একেবারেই ব্যক্তিগত অনুভূতি, কাউকে আঘাত উদ্দেশ্য নয়। এবার বা ভবিষ্যতে যারা হজ্জ করবেন, তাদের উপকারে আসতে পারে ভেবে পুনঃপ্রকাশ। আল্লাহ আমাকে সকল প্রকার রিয়া থেকে মুক্ত রাখুন; আমীন।) |
Your article helped me a lot, is there any more related content? Thanks!